ইরানের ডাক কি শুনছে বাংলাদেশ?

Anweshan Desk

Anweshan Desk

১৬ অক্টোবর ২০২২, ২২:২৭ পিএম


ইরানের ডাক কি শুনছে বাংলাদেশ?

শান্তনু চৌধুরী

সম্প্রতি  ইউরোপের একটি দেশে যাওয়া বন্ধুর (মেয়ে) সাথে কথা হচ্ছিল। হুট করে চলে যাওয়াতে দেখা করতে পারেনি এসব বলার ফাঁকে ফাঁকে সে জানালো, ওই দেশে ভালোই আছে? কী পরছে, কতক্ষণ বাইরে থাকছে এসব দেখার কেউ নেই। এই যে একটা মেয়ে স্বাধীনভাবে চলতে পারছে, তার চলার স্বাধীনতা, তার ইচ্ছের স্বাধীনতা সেটিই তাকে শতফুল হয়ে ফুটতে সহায়তা করবে। তাহলে আমাদের দেশে হঠাৎ করে সেই স্বাধীনতা হারিয়ে গেলো কেন? নাকি আগেও ছিল না। সমাজ কি আগে বেশি রক্ষণশীল ছিল নাকি ইদানিং বেশি হয়ে উঠেছে।

গেলো এক দশকে মনে হচ্ছে সেই রক্ষণশীলতা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখনই ‘কাঠমোল্লা’দের প্রবেশ ঘটেছে সে থেকে এর বিস্তারও ঘটেছে বেশ।

তবে এর মধ্যে আশা জাগানিয়া খবর হচ্ছে, ইরানের মতো কট্টর দেশের নারীরা জেগে উঠেছে। ভৌগলিক অর্থে ইরান আমাদের খুব কাছের দেশ নয়, কিন্তু ইরানে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে গড়ে ওঠা বিক্ষোভ প্রতিবাদ দেশটিকে বহু বছরের মধ্যে এবার মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আর সেটিই আশা জাগাচ্ছে। বাংলাদেশ অতটা কট্টর না হলেও ভেতরে ভেতরে যে এক ধরনের ধর্মান্ধতা দানা বাঁধছে সেকথা বলা যায়। তাই ভয় হয়, বড় ভয় হয়। যে ইরান বা আফগান অতীতে ছিল বলে ছবিতে বা বই পড়ে জেনেছি আমরা না আবার সেই পথে হাঁটি। কারণ নিকট অতীতে আমরা দেখেছি শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার কারণে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। নরসিংদীতে নারীকে পোশাকের কারণে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পোশাক নিয়ে মানববন্ধন হয়েছে, বাউলদের চুল কাটা হয়েছে, রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সবশেষ সাফ জয়ী নারী ফুটবলারদের পোশাক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ বয়ান প্রকাশ করেছে কিছু লোক।

এ প্রসঙ্গে ইরান নিয়ে একটু বলি। ঠিক ৪০ বছর আগে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব দেশটিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছিল সেদেশের মেয়েদের জীবন ও পোশাকের ক্ষেত্রে। ইরানের শাহ ১৯৩০ এর দশকে মেয়েদের নেকাব নিষিদ্ধ করেছিলেন, পুলিশকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল কোন মেয়ের মাথায় হিজাব থাকলে তা জোর করে খুলে দিতে। কিন্তু ১৯৮০’র দশকের শুরুতে নতুন ইসলামি কর্তৃপক্ষ মেয়েরা কী পোশাক পরবে তার এক নতুন ও বাধ্যতামূলক নিয়ম বলবৎ করেন। এতে বলা হয়, সব নারীকে হিজাব পরতে হবে। মূলত এরপর থেকে একে একে অধিকার হারাতে থাকেন নারীরা। বিশেষ করে কাজের অধিকার। ওই সময় এসব পরিবর্তনের বিষয়ে পুরুষদের দিক থেকে খুব একটা প্রতিবাদ আসেনি। কিন্তু এখন অনেক পুরুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। যাতে বোঝা যাচ্ছে যে প্রগতিশীল দাবির প্রতি সমাজে পরিবর্তন এসেছে।

এবার মনে হয় শেকল ভাঙার ডাক উঠেছে। গর্জে উঠেছেন খোদ ইরানের নারীরাই ধর্মীয় পুলিশের নির্যাতনে নিহত মাশা আমিনির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। এবারের বিক্ষোভের প্রধান স্লোগান হলো, ‘নারী, জীবন, মুক্তি’– যা মূলত ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান ও সমতার আহবান। আসলে কোনও কিছুই চাপিয়ে দিতে হয় না। পোশাকতো স্বেচ্ছাধীন। যার যেটা পরতে ভালো লাগে সে সেটাই পরবে। জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। বাধা দিলে একসময় বাঁধ ভাঙবেই।

তাহলে আমাদের দেশে কেন এক শ্রেণির কট্টর পন্থার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন না? কারণ এর সঙ্গে রাজনীতি জুড়ে গেছে। নারীদের পিছিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ষড়যন্ত্রতো আছেই। এর সঙ্গে আছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। সামনে শীতকাল আসছে, ওয়াজ মাহফিলের সময়। এমন অনেক ওয়াজ মাহফিলে কিছু বক্তা পাওয়া যাবে যারা নারীদের হেয় করে কথা বলে।

প্রবল নারী বিদ্বেষী পাকিস্তানিদের হটিয়ে এদেশ যারা স্বাধীন করেছিলেন তারা অনেকেই যেন আজ কট্টরপন্থার কাছে অসহায়। তাই পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আসে। কারণ এখানে ভোটের রাজনীতি। তাহলে উপায় কী? একমাত্র উপায় উচ্চশিক্ষা। আজ ইরানে যে আন্দোলন চলছে তার মূলে রয়েছে শিক্ষা। একমাত্র শিক্ষাই পারে অর্গল ভেঙে দিতে। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, যারা এই সমাজ পরিবর্তনের জন্য ডাক দেবে আমাদের দেশে তাদের অনেকেই হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ এদেশে পড়ালেখা করেন না। নেতাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে এসে নেতা হয়, আর নেতার পেছনে ঘোরা লোকজনের ছেলেমেয়েরা বখাটে হয়ে জেল খাটে। ব্যতিক্রম হয়তো আছে। সমাজের প্রতিটি সেক্টরে এখন রক্ষণশীলরা প্রগতিশীল ভেক ধরে রয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগেও পিছিয়ে থাকা সৌদি আরব এখন বিশ্বের সাথে তাল মেলোতে নিজেদের পরিবর্তন করে চলছে। সম্প্রতি তারা আন্তর্জাতিক রিয়েলিটি শো ‘আইডল’-এর সৌদি সংস্করণ সৌদি আইডলের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে।

কট্টরপন্থা নির্মূল এককভাবে রাজনীতিবিদরা যে করতে পারবেন তা নয়, সমাজের মনোজগত বদলানোর দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বা মিডিয়াকেও নিতে হয়। মনোজগত না বদলালে লাঠি আর আইন দিয়ে সমাজ বদল সম্ভব নয়।

-শান্তনু চৌধুরী ( লেখক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ) 

 


Link copied