শরীর, পোশাক ও শালীনতাবোধঃ প্রবাসী সাইনটিস্ট সিরাজুম মনিরা ইরিনা

Anweshan Desk

অন্বেষণ ডেস্ক

২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:১৯ পিএম


শরীর, পোশাক ও শালীনতাবোধঃ প্রবাসী সাইনটিস্ট সিরাজুম মনিরা ইরিনা

সাইন্টিস্ট সিরাজুম মনিরা ইরিনা

বাংলাদেশে সম্প্রতি মেয়েদের জন্য কোনটা শালীন পোশাক আর কোনটা অশালীন পোশাক এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা - সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে আর সেই ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহাত কম নয়। এই ঝড়ের কল্যাণে নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিশীল দাবি করা অনেকের মুখোশ উড়ে গেছে ও বত্রিশ দাঁতসহ বের হয়ে এসেছে তাদের বহুকষ্টে আড়াল করা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা।

এ পক্ষের দলে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, জামাতি-বামাতি, আম্লিগ-বিম্পি, বিচারপতি-চোর সবাই আছেন। সে তুলনায় অপরপক্ষের দলে বৈচিত্র্য কম; মুষ্টিমেয় দেশি নারীবাদী আর মুক্তমনা প্রবাসী লেখক-লেখিকা ছাড়া তরুণ প্রজন্মের এক অংশ।

কেউ বলছে, মুসলিম দেশে নারীর শালীন পোশাক পরা উচিত। আবার কেউ বলছে, শালীন পোশাক বলতে যদি বাঙ্গালী সংস্কৃতির পোশাক বোঝানো হয় তাহলে ব্লাউস ছাড়া শাড়ি পরাতে আপত্তি কেন? দু’পক্ষের কাদা ছোড়াছুড়ি বরাবরের মতো মূক-বধিরের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠী, যারা আধুনিক যুগের সব আরাম চায় কিন্তু নাস্তিক বা নারীবাদী ট্যাগ খাওয়ার ভয়ে পরিস্কার অবস্থান নিতে চায় না।

ছোটবেলায় দেখতাম বড়দের আলোচনার কেন্দ্রে থাকত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে 'ভালো মেয়েদের' কয়টার মধ্যে বাড়ি ফেরা উচিত এসব। মানে হচ্ছে যারা খারাপ মেয়ে, অর্থাৎ যাদের কাজ থেকে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়, তাদের একটুআধটু ধর্ষণ হতেই পারে। এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, ধাই ধাই করে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এবার পোশাক দিয়ে ভালো - খারাপ মেয়ে নির্ণয় করার পালা। এই সুযোগে নিজের অবস্থান পরিস্কার করার পাশাপাশি আপনাদের সাথে আমার জীবনের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। তাই লেখাটি লম্বা হলেও ধৈর্য্য সহকারে পড়বেন আশা করি।

পাঠকদের কথা মাথায় রেখে এই পোস্টটা কয়েক পর্বে ভাগ করছি - ১) , ২) ড্রেসকোড বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতা, ৩) পিতৃতন্ত্র, রাজনৈতিক ইসলাম ও শরিয়া, ৪) আমার শরীর, আমার পছন্দ, ৫) বাংলাদেশ ও ঘোমটার আড়ালে রাজনীতি।

আলোচনার শুরুতে কিছু টার্ম ও এদের অর্থ পরিস্কার করা জরুরী। শিক্ষিত মানুষও দেখছি না বুঝে এই টার্মগুলো ইচ্ছামতো ব্যবহার করে জগাখিচুড়ি বানিয়ে বসে আছে।

শরীর, পোশাক ও শালীনতাবোধঃ

‘শালীনতাবোধ’ হচ্ছে মানবশরীর ও পোশাক নিয়ে আপনার ‘ব্যক্তিগত’ মতামত। এই বোধ নির্ভর করে জন্মের পর আপনার মস্তিস্ককে কিভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তার উপর। প্রোগ্রামার হচ্ছে আপনার পরিবার, সমাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। কেন এই প্রোগ্রাম করা হয় তা জানতে আপনার সমাজবিজ্ঞানের কাছে যেতে হবে। বুঝতে হবে পোশাক শুধু এক টুকরো কাপড় নয়, এর পেছনে পরিবেশগত কারণ যেমন আছে, ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণও আছে।

বিবর্তনীয় নৃবিজ্ঞানের গবেষণার মাধ্যমে  জানা যায় মানুষ পরিবেশগত কারণে পোশাক পরিধান শুরু করে অন্তত ৭০,০০০ বছর আগে। মানুষ যে অঞ্চলে মাইগ্রেট করেছে, সে অঞ্চলের আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ধরণ অনুযায়ী পোশাক তৈরি করেছে। এরপর কৃষির বিকাশ ঘটে, থিতু হয় মানুষ, গড়ে ওঠে সমাজ ও কালক্রমে গোষ্ঠী/জাতী পরিচয়।

পোশাকের রাজনীতি মূলত মানুষের এই গোষ্ঠী/জাতী পরিচয়কে সম্বল করে টিকে আছে তবে এর পেছনে মূল কারণ বরাবরই অর্থনৈতিক (টাকা) ও ক্ষমতা (পুরুষতন্ত্র) ভিত্তিক।

 উদাহরণস্বরূপ, একটু চিন্তা করে দেখেন আপনি হিজাব-বোরখা পরলে কে বা কারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়? হিজাব, খিমার, বোরখা, থাব, কেফিয়েহ এইসব পোশাক পৃথিবীর কোন দেশের মানুষের ‘জাতী পরিচয়’? উত্তরের লেজ ধরে টান দিন, টানতে থাকুন, দেখবেন মাথা ঐ সৌদি আরবে! এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো তৃতীয় পর্বে।

আপনি যে পোশাক শালীন বলে মনে করেন, তা শুধুমাত্র আপনার ব্যক্তিগত মতামত। আপনার ব্যক্তিগত শালীনতাবোধ আরেকজনের পোশাক নির্বাচনে রুচির মানদণ্ড হতে পারে না। যারা নিচের ছবির মেয়েটির পোশাক নির্বাচনে শালীনতাবোধহীনতার দোহাই দিচ্ছেন, বলছেন যে কোথায় যাচ্ছে সেটা বুঝে মেয়েটির পোশাক নির্বাচন করা উচিত ছিল, তারা কি সবাই সমুদ্র সৈকতে বিকিনি পরে আদৌ যান?

মেয়েটি কিন্তু স্থান বুঝেই এমন পোশাক বেছে নিয়েছে, কেননা সে ওখানে গিয়েছে প্রতিবাদ করতে। কি নিয়ে প্রতিবাদ? বাংলাদেশে এক উগ্র ধর্মান্ধ শ্রেণী গড়ে উঠেছে যাদের মতে বাংলাদেশ হচ্ছে মুসলমানদের দেশ, আর মুসলমানদের দেশে থাকতে হলে মেয়েদের ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী পোশাক পরতে হবে। তারা যে শুধু এমনটা দাবি করে তা নয়, তারা এখন রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করা শুরু করেছে, ধর্ষিতার শরীরে পোশাক কতখানি ছিল মাপা শুরু করেছে, তাদের মন মতো পোশাক না পরলে মেয়েদের ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেয়া শুরু করেছে এবং আমরা যারা ভুক্তভোগী নারীদের পাশে দাঁড়াই তাদের ‘পশ্চিমের দালাল’ উপাধি দেয়া শুরু করেছে! অন্যায় যেহেতু ‘পোশাক’ কেন্দ্রিক তো তার প্রতিবাদও হবে ‘পোশাক কেন্দ্রিক’।

সেখানে কেউ ব্লাউস সহ শাড়ি পরে যাবে, কেউ ফতুয়া-প্যান্ট পরে যাবে, কেউ ব্লাউস ছাড়া শাড়ি পরে যাবে আবার কেউ ধুতি পরে যাবে। এই যে মেয়েগুলো নিজের পোশাক নিজে পছন্দ করে পরেছে এটাই পোশাককেন্দ্রিক-ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

পৃথিবীব্যাপী জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া ধর্মীয় ড্রেসকোড ও পুরুষতান্ত্রিক অনার কালচারের বিরুদ্ধে গত ৪০-৫০ বছরে এমন হাজারো প্রতিবাদ হয়েছে যেখানে অংশগ্রহণকারীরা অভিনব কায়দায় নারীর শরীরের স্বাধীনতা দাবি করেছেন। উচ্চ কণ্ঠে স্লোগান দেয়া থেকে শুরু করে, নাচ করে, গান গেয়ে, ছবি এঁকে, বই লিখে, এমনকি নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেছেন প্রতিবাদী নারীরা।

কেন?

যে নারী উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতে ভয় পায় না, নাচতে গিয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যায় না, নিজেকে তেঁতুল মনে করেনা, সম্মানবোধ নিজ যোনিতে সীমাবদ্ধ রাখেনা, তার সাহসই পুরুষতন্ত্রের একমাত্র ভয়।


Link copied