দিনশেষে অনুসারীরাই নির্ধারণ করে ধর্মের ভাবমূর্তি

Anweshan Desk

Anweshan Desk

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:১৫ পিএম


দিনশেষে অনুসারীরাই নির্ধারণ করে ধর্মের ভাবমূর্তি

যতই বলেন যে ধর্ম সম্পর্কে জানতে হলে অনুসারী না দেখে কেতাব দেখেন, যতই বলেন 'গো ব্যাক টু স্ক্রিপচারস', দিন শেষে অনুসারীরাই নির্ধারণ করে ধর্মের ভাবমূর্তি । আপনি কেতাব মানার জন্য মুসলমানরে বাধ্য করতে পারেন, অমুসলিমদের তো আর বাধ্য করতে পারেন না।

 

ধরেন নামাজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। ফরজ মানে অবশ্য পালনীয়। এখন পিও রিসার্চ সেন্টারের ২০১২ সালের একটা গবেষণা বলতেসে বাংলাদেশে ৩৯% মানুষ প্রতিদিন এক ওয়াক্ত হলেও নামাজ পড়েন (এর মধ্যে অনেকে পাঁচ ওয়াক্ত পড়েন, অনেকে তিন, অনেকে এক)। তাহলে নামাজ পড়েন না দেশের ৬১% মুসলমান।

 

সারা দুনিয়ার চিত্র কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেটার। রাফলি ৬০%-এর কিছু বেশি মানুষ এটলিস্ট এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন (THE WORLD’S MUSLIMS: UNITY AND DIVERSITY, 2012)। তবে এই হিসাব দেশে দেশে ভ্যারি করেছে। আলবেনিয়ায় অন্তত এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র ৭% আর ঘানায় সেটা ৯৪% (এর ভেতর ৯১% পাঁচ ওয়াক্তই পড়েন, এছাড়া ঘানার ৮৩% মুসলমান মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করেন)।

 

তো সারা দুনিয়ার ৫০ ভাগের বেশি মানুষ যখন অন্তত এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে বলে একটা পশ্চিমা গবেষণা তথ্য দেয় তখন বলতে দ্বিধা করা যায় না যে ইনডিড নামাজ ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমষ্টিগতভাবে মুসলমানদের একটা প্রবণতা আছে এইটাকে ফলো করার।

 

আমি ধর্মকে কেতাবের চোখ দিয়ে দেখি না, দেখি মানুষের প্রবণতা থেকে। সারা পৃথিবীর সব কেতাবে চুরি করা পাপ লেখা আছে, একই কথা লেখা আছে সব আইনেও। মানুষ সেটা মানছে কি-না সেটা আমি দেখবো অপরাধ প্রবণতা থেকে।

 

ধরেন ওয়ার্ল্ড ডাটা এটলাসের ২০১৮ সালের  হিসাবকে সামনে আনলে আমরা দেখবো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চুরি-ডাকাতি হয় পেরুতে (প্রতি বছর এক লাখ মানুষের ভেতর ২,০৮৬ মানুষের সাথে চুরি-ডাকাতির মত ঘটনা ঘটে)।

 

পেরুর আইনের বই খুললে কিন্তু দেখবেন চুরি ডাকাতি খুবই বাজে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

 

এখন কেউ যদি এসে বলে- "পেরুকে সবচেয়ে বেশি ডাইত্তা এলাকা বলতে হলে আগে পেরুর আইন আর সংবিধান দেখতে হবে। যদি আইনে বলা থাকে "তোমরা চুরি করো না" তাহলে পেরুর মানুষকে চোর বলা যাবে না।" তাহলে সেই লোককে নিশ্চয়ই র‍্যাশনাল বলা যাবে না। কারণ আইন থেকে কি লাভ যদি চুরি হয়-ই। আইন তো চুরি ঠেকাতে পারছে না। যেই আইন ঠেকাতে পারে না সেই আইনের আলাপ করেও লাভ নাই।  

 

যাই হোক, এই পুরো আলাপ সামনে আনার কারণ গতকালের একটা নিউজ। গতকাল বিভিন্ন পত্রিকায় "গাজীপুরে মাদরাসাছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ এক শিক্ষক গ্রেপ্তার" শিরোনামে একটা নিউজ প্রকাশিত হয়েছে। আসেন নিউজটার ভেতরে একটু চোখ দেই।

 

খবর বলা হচ্ছে- গাজীপুরের গাছা থানাধীন ডেগেরচালা এলাকা থেকে ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষকসহ মোট চার জনকে আটক করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ আলমগীর হোসেন।

 

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, মঈনুল ইসলাম হামীয়ুস সুন্নাহ মাদ্রাসায় গত আট সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটার দিকে মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষক শান্ত ইসলাম ওরফে আঃ রহমান (২২) কর্তৃক এক মাদ্রাসার শিশু ছাত্র ধর্ষিত হয়। ভিকটিমের অভিযোগ মাদ্রাসা শিক্ষক শান্ত ইসলাম ওরফে আঃ রহমান (২২) গত কয়েক মাস যাবত তাকে গালে অস্বাভাবিক ভাবে চুমু খাওয়াসহ শরীরের গোপন স্থানে স্পর্শ করতেন। গত আট তারিখ সকাল পাঁচটার সময় ঐ ছাত্রকে চকোফান বিস্কুট দেবার প্রলোভন দেখিয়ে তার বিছানায় নিয়ে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন শিক্ষক।

 

শিশুটি তার বাবাকে ঘটনাটি অবহিত করলে তার বাবা মাদ্রাসার প্রিন্সিপালসহ অন্য দুই শিক্ষককে জানান। মাদ্রাসার শিক্ষকরা বিষয়টি সমাধান করবেন বলে শিশুটির বাবাকে আশ্বস্থ করে কৌশলে কালক্ষেপন করে যাতে ধর্ষণের আলামত বিনষ্ট হয়ে যায়।

 

পরে ১২ সেপ্টেম্বর শিশুটির বাবা আবার শিক্ষকদের দ্বারস্থ হলে তারা জানায় পরীক্ষা শেষ হলে তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। ভিকটিমের বাবা মো. বাচ্চু মিয়া কোন প্রতিকার না পেলে ঘটনাটি পুলিশকে অবহিত করেন। পুলিশ সংবাদ পাওয়ার পর ধর্ষক শিক্ষককে আটক করতে গেলে মাদ্রাসার প্রিন্সিপালসহ অন্য দুই শিক্ষক পুলিশের কাজে বাধা প্রদান করে।

 

পরবর্তীতে ভিকটিমের পিতার অভিযোগের প্রেক্ষিত গাছা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় তৎসহ পেনাল কোডের ১৮৬/৩৫৩/২০২/১০৯ ধারায় মামলা রুজু হয় এবং অভিযুক্ত ধর্ষক শিক্ষকসহ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং অন্য দুই শিক্ষককে গাছা থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

 

ঘটনাটা এই পর্যন্তই। এখন আমাদের দেশে বছরে মাদ্রাসায় আঠারো বছরের নিচের ছাত্ররা আলেম ওলামাদের হাতে বলাৎকারের শিকার হচ্ছেন এবং থানায় রিপোর্ট হচ্ছে এই সংখ্যা তিনশতাধিক।

 

মাদ্রাসার ছাত্ররা বলছেন রিপোর্টেড নাম্বার প্রকৃত সংখ্যার ১ শতাংশের কম। একজন আলেমের বিরুদ্ধে মামলা করতে যেই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি দরকার সেটা অধিকাংশ দরিদ্র মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর পরিবারের নাই।

 

মজার বিষয় হচ্ছে মাদ্রাসায় ছাত্র বলাৎকারের ইস্যুতে মদ্দে মুজাহিদ জনতার ভেতর কবরের নীরবতা দেখা যায়। ছোট পোশাক পরা মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে মারতে চাওয়া মধ্যবয়স্ক আঙ্কেলদের মাদ্রাসার শিক্ষক শান্ত ইসলামদের পাথর মারার বিষয়ে কখনোই আগ্রহী হতে দেখা যায় না।

 

এখন মুসলমানদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ছোট কাপড়, ভাস্কর্য, সংগীত আর অবমাননা নিয়েই থাকবে নাকি নিজের ভাই ব্রাদারদের পোঁদ মারামারি দেখে 'গো ব্যাক টু স্ক্রিপচারস' বলে দায় মুক্ত হয়ে যাবে?

 

গত বছর পাঁচটা ছেলেকে বলাৎকার করতে গিয়ে মেরে ফেলেছেন মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। একটা ধর্মবাদী দল ন্যুন্যতম একটা মানবন্ধন কিংবা বিবৃতি দেয়ার দায় অনুভব করে নাই। এই ডিগনিটি নিয়ে তারা আরেকজনের পোশাক নিয়ে ডিসিশন নিতে চায়?

 

নিজের কমুনিটিতে খুনি-রেপিস্টদের জায়গা করে দিয়ে তারা চায় দুনিয়ার লোকজন তাদের কথা শুনবে? হাও ফানি!

 

- আরিফ রহমান ( লেখক & গবেষক ) 


Link copied