যত দোষ ‘ঝুমন-ঘোষ’!

Anweshan Desk

অন্বেষণ ডেস্ক

২৪ অগাস্ট ২০২২, ১৫:১৫ পিএম


যত দোষ ‘ঝুমন-ঘোষ’!

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার ঝুমন দাশ

বাংলায় প্রচলিত এক প্রবাদ আছে, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। প্রবাদের গল্পসূত্র দ্বাপর যুগের, যখন শ্রীকৃষ্ণের শৈশবের চাঞ্চল্যের বিচার তার মামা নন্দ ঘোষের কাছে যেত, তখন তিনি শাস্তির বদলে শ্রীকৃষ্ণকে আদর করে দিতেন। এভাবে একের পর এক। বৃন্দাবনবাসী মনে করতে লাগল নন্দ ঘোষের প্রশ্রয় পেয়েই এতখানি লাগামহীন কৃষ্ণ। এদিকে শ্রীকৃষ্ণের মামা কংসের কাছেও মহা-দোষী নন্দ ঘোষ, কারণ তার কাছে আশ্রিত কৃষ্ণ। পৌরাণিক সে কাহিনিতে বর্ণিত, যেখানে যত কিছু হতো কংসের কাছে দোষী হতেন নন্দ ঘোষ।

হিন্দুধর্মের সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ এখন নেই। তবে বহাল তবিয়তে আছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদ, মানসিকতা। পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে, সবখানে। দেশে এখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ যুগ, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের’ যুগে; কিছুদিন আগে ছিল তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার যুগ। বিপুল সমালোচনার মুখে ৫৭ ধারার যুগের বিলোপ সাধন হলেও এরপর যা এসেছে, সেটা সাতান্নের চেয়েও আগ্রাসী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে যে কাউকে হয়রানি করা যায়, এবং কোনোরূপ জবাবদিহি ছাড়াই। আগের মতো এই আইন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে, কিন্তু এই সমালোচনাকে পাত্তা দেয় না মাঠপর্যায়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ মহল।

বাংলা প্রবাদের প্রসঙ্গের অবতারণা মূলত সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাশ আপনকে ফের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের ঘটনায়। মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) ঝুমনকে আরেকবার একই আইনে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ নিজেই। ওই দিন সকালে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়, দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে, রাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে পরিবারকে আশ্বস্ত করে; কিন্তু রাতে তাকে ছেড়ে না দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখায়। ঝুমন দাশ আপনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটাও অভিন্ন; ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি’। এবার ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে আক্রমণ করেনি ঠিক, কিন্তু পুলিশ যা করল, সেটা মোটেও সুবিবেচনার নয়।

রোববার (২৮ আগস্ট) রাতে ঝুমন দাশ আপন ফেসবুকে আমাকে তার শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ফেসবুকে দেওয়ার তার পোস্টের স্ক্রিনশট আমার সঙ্গে শেয়ার করে বলেছিলেন, “এই পোস্টের জন্য পুলিশ আমায় দুপুরে ফোন দিয়েছিল। এসআই নেয়ামুল বলল, দাদা কোনো সমস্যা হবে না তো? আমি পোস্ট অনলি মি করেছি। তাদের আগের ভয় রয়ে গেছে। পুলিশ কাশিপুরের বাজারে টহল দিচ্ছে। আমি বাড়িতেই আছি ভাই”। তার পোস্ট দেখে এটাকে উসকানিমূলক মনে হয়নি, কারণ তার শেয়ার দেওয়া ওই ছবি ফেসবুকে অগণন লোক পোস্ট করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ছবিটি ছিল সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ১৪ শতকের প্রাচীন নবরত্ন মন্দিরের গেটে নবরত্ন পাড়া জামে মসজিদের দানবাক্স।

এই অগণন লোকের একজনও হতে পারতেন ঝুমন দাশ আপন। কিন্তু তা হলেন না, হলেন এর শিকার! বাংলা প্রবাদের ওই যে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের অন্যতম প্রধান উপাদান। একে তো হিন্দুধর্মাবলম্বী, তার ওপর কথিত ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। যে যেখানে যা কিছুই লিখুক না কেন, যে যেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাক না কেন, সব দোষ এ যুগের ঝুমনের; বিষয়টা যেন ‘যত দোষ ঝুমন-ঘোষ’!

ঝুমন জানালেন, পুলিশের ফোন পেয়ে ফেসবুক পোস্ট পাবলিক রাখেননি, এমনকি তার বন্ধুদের সঙ্গেও শেয়ার করেননি। তিনি যা লিখেছিলেন, সেটা অনেকেই লিখেছে, তার বেশির ভাগ অংশ অন্যের লেখার অনুলিপি। শুধু প্রশ্ন রেখেছিলেন, “কোনো মসজিদের প্রধান গেটে কোনো মন্দিরের দানবক্স লাগানোর কল্পনাও কেউ করতে পারবে না। করলে ধর্ম অবমাননার মামলা খেয়ে কারাগারে থাকতে হবে অনেক দিন। তাহলে এটা লাগানোর সাহস এরা কীভাবে করে! ওই মন্দিরের আশপাশের হিন্দুদের এটা অপসারণ করার বিন্দুমাত্র সাহস বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার ক্ষমতা নেই দেখেও আশ্চর্য হয়েছি!” এটা কি তার অপরাধ? এই প্রশ্ন করার অধিকার কি নেই তার? অধিকারের প্রশ্ন যখন করি, তখন এর উত্তর দেওয়াও সহজ। কাগজে-কলমে অন্তত এই অধিকার তার রয়েছে, এবং এটা সংবিধানস্বীকৃত অধিকার। তবু পুলিশ তাকে ফোন দেয়, তাকে ফলো করে, তাকে চাপ প্রয়োগ করে ফেসবুক পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার, এবং শেষমেশ তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের নামে নানামুখী চাপ প্রয়োগ করে রাতে সেই বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখায়। এটা কেমন স্বাধীনতা আমাদের, এটা কেমন অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদানের নমুনা?

আগেরবার ঝুমন দাশকে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন আক্রমণে পুরো গ্রাম তছনছ করেছিল ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা। ঝুমনসহ ওই এলাকার কেউই ক্ষতিপূরণ পাননি। অপরাধীরাও জামিন পেয়ে গেছে একে একে। মাঝখান দিয়ে মাসের পর মাস কারাগারে কাটাতে হয়েছে ঝুমন দাশকে। তার পরিবার পদে পদে নিগৃহীত হয়েছে, নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ওই ঘটনার পর রাষ্ট্র তার প্রতি যেখানে আন্তরিক হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। যে পুলিশ প্রশাসন হাজার-হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাদের কাউকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। লোকদেখানো কিছু বদলি ছাড়া কার্যকর কিছু করেনি রাষ্ট্র। কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এলে কীভাবে এসবের মোকাবেলা করার দরকার, সে নিয়েও ভাবেনি পুলিশ প্রশাসন। উল্টো এবার ফেসবুকে ভাইরাল একটা ছবি শেয়ারের কারণে আবার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে পড়েছেন সেই ঝুমন দাশ।

ঝুমন দাশ আপনের বিরুদ্ধে পুলিশি এই ভূমিকা মেনে নেওয়ার মতো না। এর প্রতিবাদ করি। একের পর এক নিগ্রহের চাইতে একবারেই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এই দেশ মানুষের হবে, নাকি হবে ধর্মীয় বিভক্তির; ভয় জাগানিয়া কোনো পরিবেশের! ঝুমন দাশ বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশে বসবাসের অধিকার তার রয়েছে। রাষ্ট্রের উচিত হবে তার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের।


Link copied