আওয়ামী লীগ নেতার স্কুলে হিন্দু শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মুসলিম বানানোর উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে নির্যাতন!

Anweshan Desk

মানবাধিকার ডেস্ক

৩০ অগাস্ট ২০২২, ১৫:০৭ পিএম


আওয়ামী লীগ নেতার স্কুলে হিন্দু শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মুসলিম বানানোর উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে নির্যাতন!

শিক্ষার্থীদের ইসলাম ধর্ম পড়তে বাধ্য করার ঘটনায় ঘটেছে গাজীপুরের শফিউদ্দিন মোল্লা পাবলিক স্কুলে। 

গাজীপুর মহানগরের কড্ডা এলাকার শফিউদ্দিন মোল্লা পাবলিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে ইসলাম ধর্ম বই পড়তে সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভুগীদের একটি ভিডিও ক্লিপ নিউজ অন্বেষণ এর হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী দেব চন্দ্র বর্মনের বাবা সম্ভু চন্দ্র বর্মন ও আবীর চন্দ্র বর্মনের বাবা রাজীব চন্দ্র বর্মন এই ঘটিনার বিবরণ দিচ্ছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে তাঁরা বিষয়টি টের পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যালয়ে যান এবং প্রতিবাদ জানান। চলতি মাসের প্রথম দিকে তারা বিভিন্ন অধিদপ্তরে পৃথকভাবে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

রাজীব চন্দ্র বর্মন জানান, গত মার্চ মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় বাসায় ছেলে আবীর চন্দ্র বর্মনকে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে পড়ার জন্য চাপ দেন। এসময় তার ছেলে মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরে তিনি তাঁর ছেলের গায়ের জামা খুলে ঘাড়ের নিচে বেত্রাঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। ছেলে আবীর 'ইসলাম ধর্ম বাধ্যতামূলক' না পড়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকের দ্বারা বেত্রাঘাতের শিকার হয়েছে বলে জানায়। তাকেসহ অন্য সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদেরকেও ইসলাম ধর্মের পাঠ্য বই সরবরাহ করা হয়েছে বলে ছেলের কাছ থেকে জানতে পারেন তিনি। এ ঘটনা তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী ও নিকটজনদের জানান। এসময় প্রতিবেশী দেব চন্দ্র বর্মনের কাছ থেকে একই অভিযোগ পান বাবা সম্ভু চন্দ্র বর্মন।

রাজীব চন্দ্র বর্মন জানান, পরদিন প্রতিবেশী সম্ভু চন্দ্র বর্মনকে সাথে নিয়ে তাঁরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রাজীব হাসানের কাছে সনাতন ধর্মের বই সরবরাহ না করাসহ এসবের কারণ জানতে চান। তাদেরকে সনাতন ধর্মের বই শিক্ষা অফিস থেকে বিলম্বে প্রাপ্তির কথা জানান প্রধান শিক্ষক মো. রাজীব হাসান। এর কিছুদিন পরই অবশ্য সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের সনাতন ধর্মের বই সরবরাহ করা হয়।

এ বিষয়ে শিক্ষার্থী দেব চন্দ্র বর্মন ও আবীর চন্দ্র বর্মন জানায়, বছরের শুরুতে পঞ্চম শ্রেণির অন্যান্য মুসলিম শিক্ষার্থীদের সাথে তাদেরকেও একসেট করে বই সরবরাহ করা হয়। এতে সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীরাও একটি করে ইসলাম ধর্মের বই পায়, কিন্তু কোনো সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীকে সনাতন ধর্মের বই সরবরাহ করা হয়নি। তারা জানায়, চলতি আগস্ট মাস পর্যন্ত বিদ্যালয়ে একটি টিউটোরিয়াল, একটি মাসিক মুল্যায়ন এবং একটি প্রথম সাময়িক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যেক পরীক্ষায় তাদেরকে ইসলাম ধর্মের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। তারা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে খালি খাতা জমা দিয়েছে। ওই দুটি পরিবারের অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও তাদেরকে ইসলাম ধর্মের বই পড়তে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন।

এ অভিযোগটি বিলম্বে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে রাজীব চন্দ্র বর্মনের বড় ভাই সঞ্জয় চন্দ্র বর্মন জানান, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল ইসলাম মোল্লার বাড়িতে গত ছয় বছর যাবত ভাড়ায় সপরিবারে বসবাস করে আসছেন। অতি সম্প্রতি একই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক তাদের স্বজন ও প্রতিবেশি একই বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে অশ্লীল কথা-বার্তা এবং যৌন হয়রানি করে আসছিল। ১৪ আগস্ট বাসন থানায় এ নিয়ে একটি মামলা রুজু হয়। ওই মামলায় সঞ্জয় চন্দ্র বর্মন সাক্ষী ছিলেন।

সাক্ষী থাকার 'অপরাধে' তাকে ওই বাসা ছেড়ে দিতে বলা হয়। ওই মামলাটির পর থেকে চাপা ঘটনাগুলো বেরিয়ে আসে।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজীব হাসান জানান, প্রতি বছরই তারা সনাতন ধর্মের বই দেরি করে পান। নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের নতুন শ্রেণিতে উৎসাহিত করতে নতুন বই প্রদান করা হয়। ইসলাম ধর্মসহ সকল বইয়ের সমন্বয়ে একটি সেট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অনিচ্ছাকৃতভাবে সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের কাছে ইসলাম ধর্মের বই চলে গেছে। বই প্রাপ্তির পর সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের তাদের ধর্মের বই সরবরাহ করা হয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল ইসলাম মোল্লা স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি পরিচয় দিয়ে বলেন, রাজীব চন্দ্র বর্মন ও তাদের প্রতিবেশীদের সাথে গত প্রায় তিন বছর যাবত জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। সনাতন ধর্মের লোকজন তাদের বাসস্থানে তাঁর জমির ওপর পায়ে হাঁটার পথ দিয়ে যাতায়াত করছে। বড় করে রাস্তা নেওয়ার জন্য অনেকদিন ধরে নানা ধরণের ফন্দি ফিকির করছে।

বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী অর্ণব ও জোবায়ের জানায়, তারা একই বিদ্যালয়ে উভয় ধর্মের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে আসছে। প্রত্যেক শ্রেণিতেই তাদের মতো সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীও রয়েছে। সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের ইসলাম ধর্মের বই পড়েত বাধ্য করার ঘটনা আগে ঘটেনি।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য কাজ করে এমন একটি সংগঠন বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচ। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষ ভুক্তভোগীদের কাছে গিয়ে সরজমিনে বিষয়টি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কতৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন।

গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ মুরাদ আলী জানান, অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলো জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকা সুলতানা এবং বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)  মালেক খসরু। আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ইউএনও বলেন, রোববার অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই ওই স্কুলে গিয়ে অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর অভিভাবক সম্ভু চন্দ্র বর্মণকে পাইনি। তবে তাঁর ছেলে দেব চন্দ্র বর্মণসহ একাধিক সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলেছি। অভিযোগের সাথে শিক্ষার্থীদের বক্তব্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। বিষয়টি হলো যখন শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করা হয় তখন এক সেট বইয়ের সাথে মাঝে মাঝে কোনো একটা বই বোর্ড থেকেই কম আসে। স্কুলের শিক্ষকেরা সেদিকে লক্ষ্য না করেই সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদেরকেও ইসলাম ধর্ম বই বিতরণ করে দিয়েছে। যেটা অসতর্কতা ও অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেই মনে হচ্ছে। জোর করে ইসলাম ধর্ম পড়তে হবে এরকম কোনো চাপ বা প্রেসার শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। স্কুলে প্রধান শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন, আভিযোগকারীর সাথে স্কুলের জমি দাতার ভূমি নিয়ে একটা বিরোধ রয়েছে। এ বিরোধের জেরে অভিযোগটি দেওয়া হয়েছে কি’না সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।


Link copied