শহীদজায়া পান্না কায়সারের প্রতি জাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি
০৬ অগাস্ট ২০২৩, ২৩:৪৯ পিএম

শহীদজায়া, সাবেক সাংসদ, শিশু সংগঠক এবং ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সম্মানিত উপদেষ্টা অধ্যাপক পান্না কায়সার গত ৪ অগাস্ট সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার এর সহধর্মিণী ছিলেন।

পান্না কায়সারের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণ শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন।
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ রোববার সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবং পরবর্তীতে বাংলা একাডেমিতে রাখা হয় পান্না কায়সারের মরদেহ।
মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হলে সেখানে প্রথমে শ্রদ্ধা জানায় তার তৈরি শিশু-কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’। কেন্দ্রীয় খেলাঘরের পক্ষে স্যালুট জানিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর মরদেহে খেলাঘরের পতাকা দিয়ে আবৃত করা হয়। এরপর খেলাঘরের বিভিন্ন শাখা শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পরে একে একে গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক কমিটি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাগরণ সংস্কৃতিক স্কোয়াড, ধানসিঁড়ি কমিউনিকেশন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ঢাকা থিয়েটার, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, সংস্কৃতি মঞ্চ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, ছায়ানট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, প্রজন্ম একাত্তরসহ আরও অনেক সংগঠন ও ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন মহলের গুণীজনরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য এবং দেশকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। তার স্বপ্নের সেই দেশ গড়ে তোলার জন্য আমরা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কাজ করে যাবে। এ ক্ষেত্রে পান্না কায়সার আমাদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কাইসারের চাচাতো ভাই, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘১৯৭২ সালে আমরা প্রথম যখন রাজাকারদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছি সেই আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে ছিলেন। তিনি সারা জীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ তৈরিতে কাজ করে গেছেন। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন ছিলেন এবং শিশু ও কিশোরদের ৭১ এর চেতনায় উজ্জীবিত করতে তিনি 'খেলাঘর' প্রতিষ্ঠা করেন।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘তিনি সবার ভালোবাসা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও গুণাবলির কারণে। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে পটভূমি তৈরিতে পান্না কায়সার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন। সেটি হলো, নতুন প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ যাতে নতুন প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত হয় সেজন্য তিনি খেলাঘর প্রতিষ্ঠানটি আমৃত্যু পরিচালনা করেছেন। খেলাঘরের মাধ্যমে সারা দেশের শিশুদের সম্পৃক্ত করে তাদের মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ করে, নৈতিক গুণাবলিতে উন্নত চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করেছেন তিনি।’
শ্রদ্ধা নিবেদন করে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, 'শহীদুল্লা কায়সার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর তিনি (পান্না কায়সার) সন্তানদের মানুষ করেছেন। তিনি আজীবন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতেন তিনি। আমরা তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।'
শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, ‘তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। আমরা চাই, তার আশার সেই বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নির্মাণ করতে কাজ করেছেন। তার চলে যাওয়া আমাদের দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য, শুদ্ধ সংস্কৃতির জন্য একটি বড় অপূর্ণতা দিয়ে যাবে।’
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ে তোলা আমাদের একটি বড় দায়িত্ব। পান্না কায়সার সেই দায়িত্ব সারা জীবন সুন্দরভাবে পালন করে গেছেন।'
ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, 'স্বামীকে হারিয়েও তিনি নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে। জীবনভর লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। খেলাঘর সংগঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি।'
পান্না কায়সারের কন্যা অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, 'আমার মা কষ্ট থেকে শক্তি অর্জন করেছেন, কোনোদিন প্রকাশ করেননি। মাত্র ২১ বছরে তিনি বিধবা হন, তারপর এ বাংলাদেশে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি লড়াই করে গেছেন। এরই মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাসের বাইরে সঠিক ইতিহাস প্রচারে নিরন্তর লড়াই করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শ বাস্তবয়ানে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।'
চলচ্চিত্র অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন জীবন্ত ইতিহাস তিনি। বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে তিনি আজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য তার ত্যাগ বিশাল। এই ত্যাগ আমরা আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো। তার জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তিনি বাংলাদেশকে ধারণ করে গেছেন। একজন মা চলে যাওয়ায় আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, তিনি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।'
শহীদজায়া অধ্যাপিকা পান্না কায়সার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বদরুন্নেসা কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। গবেষণাভিত্তিক লেখালিখির জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।