অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত, আ’লীগ সভাপতিকে অব্যাহতি
০১ জুলাই ২০২২, ১৫:৫৭ পিএম

ধর্মানুভুতিতে আঘাতের গুজব ছড়িয়ে নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে মারধর, গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত এবং হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার ঘটনার সাথে সরাসরিভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. আকতার হোসেনকে সভাপতি পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি ও তিন দিনের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) বিকেলে নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. অচিন কুমার চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক এড. ওমর ফারুক এ বিষয় নিশ্চিত করেছেন।
নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্যাডে কারণ দর্শানোর নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গত ১৮ জুন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্রের মোবাইল ফোনের স্ট্যাটাস নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আপনি উক্ত কলেজের একজন শিক্ষক ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরিশেষে দেখা যায় আপনার উপস্থিতিতে উক্ত কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে বের করা হয়। যাহা নিন্দনীয়, শিক্ষক সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করার সামিল।’
নোটিশে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘বিভিন্ন প্রকার পত্র-পত্রিকায় ও মিডিয়ায় আপনাকে জড়িয়ে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। যার দায় আপনি এড়াতে পারেন না। আমরা মনে করি সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।'
সভাপতির পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়ার পর তাঁর অবর্তমানে সহ-সভাপতি মশিয়ার রহমান দায়িত্ব পালন করবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায়ের ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টকে কেন্দ্র করে এই ঘটনার সুত্রপাত হয়। সেই পোস্টে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে রাহুল লিখেছিলেন, “প্রণাম নিও বস ‘নূপুর শর্মা’ জয় শ্রীরাম”। এ পোস্টকে কেন্দ্র করেই ওঠে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়ায় স্থানীয় ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী মুসলমানদের একটি চক্র। এর জেরেই গুজব ছড়িয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই কলেজের ভারপ্রাপ্ত (পূর্বের) অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পরানো হয় জুতার মালা।
গত ১৮ জুন ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা কলেজ চত্বরে থাকা শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেয়। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছোঁড়ে। ঘটনার সময় ২ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
পরে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ও কর্মকর্তাদের সামনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর গলায় জুতার মালা পরিয়ে কলেজ চত্বরে ঘোরানো হয়।
ঘটনার পরদিন ১৯ জুন দুপুরে মির্জাপুর কলেজের হল রুমে নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তি উগ্রপন্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন।
গ্রেফতার দেখানো হয় একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায়কে। তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। রোববার (২৬ জুন) নড়াইল সদর আমলি আদালতে তার বিরুদ্ধে পুলিশ পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করলেও মঞ্জুর করেননি আদালত।
ঘটনার পর, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অব্যাহতি দিয়ে ওই কলেজের শিক্ষক আকতার হোসেন টিংকুকে নতুন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো।
জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘অধ্যক্ষের গলায় কেউ জুতার মালা পরিয়েছিল কি না, তা আমি দেখিনি। কলেজের বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর ধরে ইসলাম ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মানুভুতিতে আঘাতের গুজব ছড়িয়ে উগ্রপন্থী ও ধর্মান্ধ মুসলমানদের একটি চক্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে নির্যাতন, লাঞ্ছিত, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু অধিকার কর্মীদের অভিযোগ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রের ধর্মীয় উগ্রবাদ তোষণের কারণে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।