দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানানোর পরিকল্পনা ছিলো আমিরের

Anweshan Desk

Anweshan Desk

২৫ জুলাই ২০২৩, ১৫:২৫ পিএম


দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানানোর পরিকল্পনা ছিলো আমিরের

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানাতে চেয়েছিলেন 'শারক্বীয়া’র আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে আমির মাহমুদ। দেশের বাইরে হামলার পরিকল্পনা না থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। আর 'কিলিং মিশন' ছিল টার্গেট। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছিলেন আমির।

রোববার ভোর রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে নতুন জঙ্গি সংগঠনের আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর একটি দল।

বাকি দুই গ্রেপ্তার হলেন কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ (৩৪) ও মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি (২৮)। এই দুই জন হলেন আমিরের দেহরক্ষী। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছে থেকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদী বই জব্দ করা হয়।

সোমবার (২৪ জুলাই) দুপুরে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানাতে চেয়েছিলেন শারক্বীয়ার আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। দেশের বাইরে হামলার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও দেশের মধ্যে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তাদের টার্গেট ছিল কিলিং মিশন। আর তাদের আইনের আওতায় আনতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছিলেন আমির মাহমুদ।

 

কে এই আমির মাহমুদ?

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আনিসুর রহমান  ওরফে আমির মাহমুদ কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের একটি সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। এর আগে হুজির সদস্য ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে আনসার আল ইসলামের রক্সি ও ফেলানীর সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর তারা যাত্রাবাড়ীতে মিটিং করে নতুন একটি সংগঠন তৈরি ও বিস্তারের পরিকল্পনা করে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কার্যক্রম শুরু করেন।

আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। ২০১৬ সাল বিভিন্ন সময় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের পক্ষে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি। ২০২০ সালে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বান্দরবানের গহীন এলাকায় যান তিনি। বান্দরবানে আসলাম নামক এক ব্যক্তির কাছে প্রায় এক মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালনা ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। আমির মাহমুদ কুমিল্লার প্রতাপপুরে বাড়িসহ তার জমিটি ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। জমি বিক্রির কিছু টাকা সংগঠনে দেন। বাকি টাকা দিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে তিন বিঘা জমি কিনে ওই বছরই সেখানে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন আমির মাহমুদ। সেখানে তিনি পোল্ট্রি ফার্ম, চাষাবাদ ও গবাদিপশুর খামার পরিচালনা করতেন।

গ্রেফতার আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানায়, আগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালে রক্সি গ্রেফতার হলে সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের সিদ্ধান্তে মাহমুদকে আমির করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের সময় মাহমুদের সঙ্গে কেএনএফ সদস্যদের পরিচয় হয় এবং কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। পরবর্তীতে ২০২১ সালে কেএনএফের ছত্রছায়ায় বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে চুক্তি হয় তাদের মধ্যে।

 

আমির মাহমুদের নির্দেশে ঢাকায় ছিলেন নাথান বম

কমান্ডার মঈন বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেবে কেএনএফ। এজন্য প্রতিমাসে কেএনএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও খাবার খরচ বাবদ ৩-৪ লাখ টাকা দিতেন আমির মাহমুদ। এই অর্থ দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হতো। এছাড়া আমির মাহমুদের নির্দেশনায় কেএনএফ থেকে ১৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের ভারি অস্ত্র ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র কেনা হয়, যা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আমির মাহমুদের নির্দেশনায় কেএনএফ প্রধান নাথান বমকে রাজধানীর বাসাবোতে সংগঠনের অর্থায়নে একটি বাসাভাড়া করে দেওয়া হয়। যেখানে নাথাম বম পরিবারসহ মাঝে মধ্যে অবস্থান করতেন।

র‌্যাব জানায়, কেউ যদি প্রশিক্ষণ নিতে অসম্মতি জানাতেন বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন তাহলে তাকে জঙ্গি সংগঠনের বানানো জেলখানায় বন্দি করে রাখা হতো। এছাড়া কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বা বিদ্রোহ করলে তাকে গুলি করে হত্যার ঘোষণা দেন আমির মাহমুদ।

 

শীর্ষ জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ার সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয় আমির মাহমুদের

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, আমির মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি মেজর জিয়ার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে একটি মিটিংয়ে আমির মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী আনসার আল ইসলাম আমির মাহমুদকে ১৫ লাখ টাকা দেয়। এজন্য জামাতুল আনসারের সদস্যদের আনসার আল ইসলাম আইটি ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে। বিনিময়ে আনসার আল ইসলামের সদস্যদের জামাতুল আনসার পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করবে। এ বিষয়ে মাহমুদ কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে অবহিত করেন ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় করেন।

 

পাহাড়ে অভিযান শুরু হলে আত্মগোপনে যান আমির মাহমুদ

র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর অভিযান শুরু হলে আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ পাহাড় থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন। সংগঠনকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য পলায়নকৃত ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন আমির মাহমুদ।

র‌্যাব জানায়, কেএনএফ প্রধান নাথান বম পার্শ্ববর্তী দেশের মিজোরামে অবস্থান করছেন। বিভিন্ন সময়ে কেএনএফের হামলা ও আক্রমণের বিষয়ে আমির মাহমুদের ইন্ধন থাকতে পারে।

 

গ্রেফতার কাজী সরাজ ২০০৪ সালে হুজিতে যোগ দেন

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ স্থানীয় একটি পলিটেকনিক্যাল ইনসটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষে পটুয়াখালীতে ব্যবসা করতেন। তিনি ২০০৪ সালে জঙ্গি সংগঠন হুজিতে যোগ দেন। হুজির কার্যক্রম স্তিমিত দেখে ২০১৪ সালে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে গ্রেফতার শাওনের মাধ্যমে জামাতুল আনসারে যোগ দেন কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ। তিনি মূলত ইলেকট্রিক্যাল কাজ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শীদের বাছাই করে সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

 

মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন গ্রেফতার মাহফুজুর

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি সিলেটের জগন্নাথপুরে একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৮ সালে গ্রেফতার রনবীরের মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করেন ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন মাহফুজুর। তিনি সিলেট অঞ্চলে দাওয়াতি শাখার আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন। সিলেট অঞ্চলের যোগদান করা সদস্যদের ভুল বুঝিয়ে তথাকথিত জিহাদ ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতেন।


Link copied