লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী : জায়গা হচ্ছে না হাসপাতালের মেঝেতেও
২৪ জুলাই ২০২৩, ১৩:১৮ পিএম

চোখের সামনে ডেঙ্গুতে মায়ের মৃত্যু। রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে এমন দৃশ্য এখন রোজকারের। ছবি : সমকাল
ভীতি ছড়িয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। সরকারি হাসপাতাল রোগীতে গমগম। কোনো কোনো হাসপাতালে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ ভর্তি। শয্যা সংকটে রোগী ফেরত দেওয়ায় এখন বেসরকারি হাসপাতালেও বাড়ছে চাপ। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হওয়ার শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে সর্বাত্মক প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ তাদের। তবে হাসপাতালের চেহারা বলছে ভিন্ন কথা, নেই আগাম প্রস্তুতির ছাপ। এখনও হযবরল অধিকাংশ হাসপাতাল। শয্যা সংকটে জটিল রোগী ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়ার অভিযোগ উঠছে প্রতিদিন। এমন বেগতিক পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সব প্রস্তুতি রাখা হয়েছে, অবস্থা বুঝে নেওয়া হবে ব্যবস্থা।
এদিকে এক দিনে ডেঙ্গুতে আরও ২ হাজার ২৯২ জন আক্রান্ত হয়ে আগের দিনের রেকর্ড ভেঙেছে, যা গত ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শনিবার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৪২। গত চব্বিশ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ৯ জন।
৩৬ বছর বয়সী আজিজুর রহমান থাকেন রাজধানীর মুগদায়। হাসপাতাল থেকে খুব কাছেই তাঁর বাসা। অথচ ডেঙ্গু আক্রান্তের পর ঠাঁই হয়নি কাছের হাসপাতালটিতে। বাধ্য হয়ে ভর্তি হন বনশ্রীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। আজিজুর রহমান বলেন, মুগদা হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শয্যা পাওয়া যায়নি। এমনকি মেঝেতেও জায়গা নেই। পরে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। দু’দিনে এরই মধ্যে ২৪ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
এই যখন বাস্তবতা, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর বর্তমান অবস্থাকে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণা দিয়ে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে সরকারকে।
হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তিন ধাপে সাজাতে হবে। শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসক ও নার্সদের প্রস্তুত করতে হবে। তবে রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। সব হাসপাতালে চালু হয়নি ডেঙ্গু কর্নার। বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীকে অন্যদের সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। অনেকেই ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে উঠে নানা জটিলতার মুখে পড়লেও চালু করা যায়নি পোস্ট ডেঙ্গু ক্লিনিক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ হবে ডেঙ্গুর বিস্তার। এ কারণে ঢাকার বাইরেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ, রোগী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি চিকৎসক দল গড়ে তুলতে হবে। জটিল রোগী চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে রোগীকে ঢাকায় আসতে না হয়। এতে রোগীর মৃত্যু এবং ঢাকার রোগীর চাপ কমবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ বিস্তার ছিল অক্টোবরে। এখন যে অবস্থা, তা উঠতির দিকে। অক্টোবরের আগেই পিকে চলে যায় কিনা, বলা যাচ্ছে না। যে পরিস্থিতি তাতে বলা যায়, এ ধারা চলবে আরও কয়েক মাস। গত বছর শীতেও রোগী পাওয়া গেছে। ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে শয্যার পাশাপাশি পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়তে হবে। সব রোগীর মশারি নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামে উপজেলা হাসপাতালগুলোর মতো শহরে সিটি করপোরেশনের সব হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এখন হাসপাতালে শুধু জটিল রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এখনই বড় কর্মসূচি নিয়ে মশা নিধন করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেবে। সেই অনুযায়ী যদি রোগী ব্যবস্থাপনা করা যায়, তাহলে প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ডেঙ্গুর বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, অধিদপ্তর থেকে বিশেষ কোনো বার্তা আসেনি। বাড়তি রোগী সামাল দিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর চাহিদা এক মাস আগে দেওয়া হলেও মাত্র ৩০ শতাংশ পাওয়া গেছে। আরও রোগী বাড়লে চিকিৎসা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, রোগী বাড়তে পারে, নাও বাড়তে পারে। তবে রোগী বাড়লে হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো হবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গুর যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় অধিদপ্তর সক্ষম। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কী অবস্থা হবে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। প্রাদুর্ভাব বাড়লে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র আছে। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ আছে। ঢাকায় প্রকোপ বেশি হলে দক্ষিণ সিটির মহানগর জেনারেল হাসপাতাল ও উত্তর সিটির ডিএনসিসি হাসপাতাল, গাবতলীর লালকুঠি হাসপাতালকে ডেঙ্গুর জন্য প্রস্তুত করা হবে।
এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত
ডেঙ্গুতে গত চব্বিশ ঘণ্টায় আরও ৯ জন মারা গেছেন। এ বছর মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৭৬-এ। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ২৯২ জন। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ হাজার ৯৭৭ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ হাজার ৯৪৯ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩ হাজার ২৮ জন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়।
উচ্চঝুঁকিতে ঢাকার ১১ এলাকা
এদিকে গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এ বছর ৩০ হাজার ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ১৮ হাজার ৮৮৫ জনই ঢাকার। ঢাকা মহানগরীর ১১ এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে বেশি ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় রয়েছে যাত্রাবাড়ী, মুগদা, কদমতলী, জুরাইন, ধানমন্ডি ও বাসাবো। উত্তর সিটি এলাকায় রয়েছে উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও ও বাড্ডা।