গ্রাম্য সালিশে প্রবাসীর স্ত্রীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপ

Anweshan Desk

Anweshan Desk

০৮ এপ্রিল ২০২৩, ২৩:২০ পিএম


গ্রাম্য সালিশে প্রবাসীর স্ত্রীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপ

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে গ্রাম্য সালিশে ওমান প্রবাসীর স্ত্রীকে বেত্রাঘাত ও পাথর মারা হয়েছে। এই ঘটনার শিকার নারীর মামলার পর এখন পর্যন্ত চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- উপজেলার বড়জুম গ্রামের বাসিন্দা হাফেজ নুরুল ইসলাম (৩৫), বায়েজিদ হোসেন (৭০), আকবর আলী (৬৮) ও আতিক উল্লাহ (৫০)।

চুনারুঘাট থানার ওসি মো. রাশেদুল হক জানান, শুক্রবার (৭ এপ্রিল) রাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার বিবরণে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায় , চুনারুঘাট উপজেলার একটি গ্রামে ওই নারীর স্বামীর বাড়ি। তার স্বামী ওমানপ্রবাসী। স্বামী বিদেশে থাকায় বিভিন্ন প্রয়োজনে ওই নারীর বাসায় আসা-যাওয়া করতেন পার্শ্ববর্তী সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আবুল কালাম। এ সুযোগে ওই গৃহবধূর কিছু ভিডিও মোবাইলে ধারণ করেন। এরপর থেকে ওই নারীকে যৌন হয়রানি করে আসছিলেন। তার সঙ্গে প্রেম ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে তিনি গ্রামে প্রচার করতে থাকেন। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ওই নারীর ওপর ক্ষিপ্ত হন।

এতে ওই নারীর বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে গত ৪ এপ্রিল রাতে এক সালিশ বিচারের আয়োজন করে গ্রামবাসী। বিচারে ওই নারীকে ৮২টি বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় গ্রাম্য মাতবর বায়েজিদ হোসেনের সভাপতিত্বে নুরুল ইসলামসহ স্থানীয় লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সালিশে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগে ওই নারীকে ৮২টি বেত্রাঘাত ও ৮০টি পাথর নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী স্থানীয় আকবর আলী (৬৮) ওই নারীকে একে একে ৮২টি বেত্রাঘাত করেন। একই সময় উপস্থিত সবাই পাথর নিক্ষেপ করেন। একপর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ওই নারী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

এছাড়াও ওই নারীকে এক মাস ঘর থেকে বাহির হতেও নিষেধ করা হয়। স্ত্রীর এমন খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার দেশে ফিরে আসেন প্রবাসী স্বামী। নির্যাতনের বিষয়ে বিচারের জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নিতে চাইলেও গ্রামবাসী ওই প্রবাসীকে বাঁধা দেন। এক পর্যায়ে ভোক্তভুগী নারী নিজেই বাদী হয়ে চুনারুঘাট থানায় অভিযোগ দেন।

এদিকে এ ঘটনার পর ওই অটোরিকশাচালক আবুল কালাম গা ঢাকা দেন। 

নির্যাতনের শিকার ভোক্তভুগী নারী জানান, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই। পরিচিত হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময় তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন ওই অটোরিকশা চালক। তিনি বিভিন্ন সময় তাকে (ভুক্তভোগী) প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে উত্ত্যক্ত করতেন। গোপনে কোনও এক সময় ওই ব্যক্তি কিছু ভিডিও ধারণ করেন। পরে সেই ভিডিও দেখিয়ে প্রচার করেছেন, ওই ব্যক্তির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তার কারণেই আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রামের কিছু মাতব্বর বিষয়টি অতিরঞ্জিত করে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে লজ্জায় আমি ঘর থেকে বের হতে পারছি না। আমার স্বামী দেশে আসার পর গ্রামবাসী তাকেও ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।

ভুক্তভোগী নারীর স্বামী বলেন, ‘অপরাধ যদি হয়, নারী-পুরুষ উভয়ই করেছেন। গ্রামবাসী শুধু নারীর বিচার করেছেন। অথচ যিনি ভিডিও ছড়িয়ে আমার স্ত্রীকে হেয় করেছেন, তার বিচার কে করবে?’

জানতে চাইলে স্থানীয় রফিক মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘ঘটনার সত্যতা যাচাই-বাছাই না করে এভাবে একজন নারীকে নির্যাতন করা উচিত হয়নি। ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। না হলে নারীদের প্রতি বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিষয়টি গণমাধ্যমের মাধ্যমেই প্রথম জেনেছি। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সালিশে প্রেমের অভিযোগে ওই নারীকে তওবা করানো হয়। তবে  প্রেমের সম্পর্কটি কতটুকু সঠিক তা আমার জানা নেই। যেহেতু মামলা হয়েছে পুলিশ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা বের করবে এবং পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি ওই নারী কোনও সহযোগিতা চান অবশ্যই সহযোগিতা করবো।’

এ প্রসঙ্গে চুনারুঘাট উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী নেত্রী আবিদা খাতুন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি পুরোপুরি অবগত নই, তবে ঘটনাটি দুঃখজনক।’

হবিগঞ্জের কবি ও নারী নেত্রী তাহমিনা বেগম গিনি বলেন, ‘নারীদের প্রতি বৈষম্য কমছে না। আরব দেশেও এখন নারীদের প্রতি এত নির্যাতন করা হয় না। চুনারুঘাটে গ্রাম্য মাতবররা একজন নারীকে ৮২ বার বেত্রাঘাত এবং ৮০টি পাথর ছুড়ে মারলো। কত সাহস হলে এরকম ঘটনা ঘটে। বিচার কি পাবে ওই নির্যাতিতা নারী?’

চুনারুঘাট থানার ওসি মো. রাশেদুল হক বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অপর আসামিদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

 

 


Link copied