জনগণকে 'স্যার' বলে সম্বোধন করে আসছেন যে সরকারি কর্মকর্তা
২৬ মার্চ ২০২৩, ১৭:৫৮ পিএম

বরিশালের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তৃতীয় তলার উত্তর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নামফলকে লেখা ‘জেলা প্রবেশন অফিসারের কার্যালয়’। ভেতরে ঢুকতেই সাজানো-গোছানো পরিপাটি ছোট কক্ষটির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানা মানবিক কাজের বাঁধাই করা ছবি। পেছনের তাকে থরে থরে সাজানো সম্মাননা ক্রেস্ট, বিভিন্ন বিধিবিধানের বইপত্র। প্রবেশন কর্মকর্তার টেবিলের সামনে দর্শনার্থীদের দিকে ঘোরানো একটি ফলক। তাতে লেখা ‘স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি’?
২০১৮ সাল থেকে নিজের কার্যালয়ের টেবিলে এমন ফলক লাগিয়েছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা। তাঁর নাম সাজ্জাদ পারভেজ।
সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ ডাকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এমন সময়ে সাজ্জাদ পারভেজের বিষয়টি অন্য রকম উদাহরণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘যাঁদের টাকায় আমার বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, তাঁরা তো সম্মানিত, না কি? বরং এখানে আমরা উল্টোটাই ভাবি। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। কারণ, আমার গ্রাহক হচ্ছেন মানুষ। তাঁদের সম্মান দিতে না পারলে আমি কীভাবে তাঁদের সেবা দেব? সেবা দেওয়ার জন্যেই তো আমাকে এখানে বসানো হয়েছে, দয়া করার জন্য নয়, এটাই তো প্রকৃত শুদ্ধাচার।’
সাজ্জাদ পারভেজের কথায় জানা গেল তাঁর দপ্তরের কাজই হলো মানুষের সেবা করা। যেমন, অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা, দুস্থদের পড়াশোনায় সহায়তা দেওয়া, কারাগারে মানবিক সহায়তা, জীবিকার জন্য প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা বাড়ানো, দুস্থ নারীদের পুনর্বাসন, অনাথ শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা, লঘু অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্তদের প্রবেশনে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়া, পরিচয়হীন শিশুদের পরিচর্যা, বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করা, সমাজ থেকে বিচ্যুত কিশোরীদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। এসব কাজ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, মানুষের এত এত সমস্যা যে তাদের দপ্তরের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব না। তাই তিনি ঠিক করেছেন, বিপদগ্রস্ত হয়ে সেবা নিতে আসা মানুষটি যেন তাঁর ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়।
সাজ্জাদ পারভেজ বললেন, ‘আমি এই ভাবনার খুবই ইতিবাচক ফল পেয়েছি। মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে আমি একাত্ম হতে পেরেছি। সহায়তা না পেলেও কারও আক্ষেপ থাকে না।’
আমিনুল ইসলাম নামে নগরের এক যুবক তাঁর বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসা সহায়তার জন্য গত বছর সমাজসেবা কার্যালয়ে সহায়তার আবেদন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাবাকে নিয়ে যেদিন আবেদনটি জমা দিতে তাঁর কার্যালয়ে যাই, তখন সাজ্জাদ পারভেজ আমার বাবাকে স্যার সম্মোধন করছিলেন। আমার বাবা অবাক হয়েছিলেন, আমিও বিষ্মিত হয়েছিলাম। আমার জীবনে কখনো কোনো সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে গিয়ে এমন আচরণ দেখিনি। আসলে সহায়তার চেয়েও তাঁর আচরণে আমরা বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার অসুস্থ বাবা এখনো সেই গল্প করেন।’
২০১৮ সাল থেকে কেন এমন চর্চা শুরু করলেন, জানতে চাইলে সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করি। চাকরির পরও সেই চর্চাটি অব্যাহত রাখি। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি আমাদের সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরিশালে আমাদের কার্যক্রম পরিদর্শনে এসেছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন বিষয়ে আলাপের মধ্যেই তিনি বলছিলেন, আপনার দপ্তরে যেসব অসহায় মানুষ সেবা নিতে আসেন হয় তো তাঁদের সবাইকে আপনি সহায়তা করতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর সঙ্গে অন্তত সম্মানজনক ব্যবহার করুন। পরের দিনই অফিসের টেবিলে একটি ফলক লাগালাম। সেবা নিতে আসা প্রত্যেককেই আমি স্যার সম্বোধন করি।’
বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সাজ্জাদ পারভেজ নিঃসন্দেহে একজন মানবিক ও দায়িত্ববান কর্মকর্তা। আমি এখানে যোগদান করার পর দেখেছি উনি কীভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে আসেন কোনো না কোনো ভুক্তভোগীকে নিয়ে। এটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। তাঁর এমন কাজ প্রশংসনীয়, অন্যদের জন্য অনুকরণীয়।’