বদলেছে সময়, প্রেমের বিয়ে সহজেই মেনে নিচ্ছে পরিবার

Anweshan Desk

Anweshan Desk

১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১২:৩২ পিএম


বদলেছে সময়, প্রেমের বিয়ে সহজেই মেনে নিচ্ছে পরিবার

Photo : Nijol Creative

‘ছেলেমেয়ের জন্য উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ বাবা-মায়ের জন্য। তারা বড় হয়েছে। নিজেদের জীবনসঙ্গী নিজেরা পছন্দ করে নিলেই বরং আমরা কঠিন এই দায়িত্ব থেকে রেহাই পাই!’ মজার ছলেই হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক শাহানা বানু।

একসময় প্রেম মানেই ছিল পরিবারের কাছে নিষিদ্ধ কিছু বা এমন কিছু যা অপরাধের শামিল। প্রেম করে বিয়ের প্রসঙ্গ আনতে গিয়ে ভাবতে হতো হাজারবার। পরিবারকে বোঝাতে গিয়ে ছেলে কিংবা মেয়ে দুজনেরই শত মহড়া দিয়ে প্রস্তুত করতে হতো কথার বহর। প্রত্যাখ্যানের ভয়, আত্মীয়স্বজন কী বলবে এসব ভাবতে গিয়ে পরিণতি পেতো না অনেক প্রেমের সম্পর্ক।

'একসময় অভিভাবকরাও সনাতন ধারার চিন্তা থেকে বের হতে না পারার কারণে সন্তানের পছন্দকে গুরুত্ব  দিতেন না মোটেই। সন্তানের বিয়ের ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থাকতেন তারা। ফলে পরিবার হারানোর ভয়ে হারিয়ে ফেলতে হতো পছন্দের মানুষটিকেই।'

তবে দিন এখন অনেকটাই বদলে গেছে। বদলেছে মানসিকতা। বর্তমানে বিয়ের মতো বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পরিবার থেকেই ভরসা রাখা হয় সন্তানদের পছন্দের ব্যাপারে। সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সন্তানের চাওয়াকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন বর্তমানের অভিভাবকেরা। এমনটিই দেখা যায় বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক কাজী তামান্না হক সিগমা প্রেম করে বিয়ে করেছেন ১৪ বছর আগে। একসময় বিভাগের অগ্রজকে ভালোলাগা থেকে প্রণয়ের মাধ্যমে এখন তারা জীবনসঙ্গী। সিগমা জানান, প্রথম দিকে বাসা থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন থাকলেও তারা যখন দুজনকে নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তখন তাদের সম্পর্ককে দুই পরিবারই সহজে মেনে নেয়। সিগমা বলেন, ‘প্রত্যেকটি অভিভাবকেরই অধিকার আছে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার। তবে সন্তানদের পছন্দের ওপর ভরসা করাও জরুরি। কারণ, শেষ পর্যন্ত জীবনটা তার। বরং সন্তানদের ভালোমন্দ শিক্ষাটা পরিবারের এমনভাবে দেওয়া উচিত, যেন তারা নিজেদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায়, অনেক সময় পারিবারিকভাবে বিয়েতে ঠিকভাবে সমঝোতাটা হয়ে ওঠে না দুজনের মধ্যে। তখন পরিবারের মধ্যেই নানান টানাপোড়েন চলতে থাকে। সে হিসেবে প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের বোঝাপড়া জন্মে যায় আগে থেকেই। এই মানসিকতার কারণেই বর্তমানের অভিভাবকেরা তাদের নিজেদের পছন্দের তুলনায় সন্তানের পছন্দকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।

ফ্যাশন ব্র্যান্ড শরদিন্দুর স্বত্বাধিকারী হাবিবা আক্তার সুরভী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকেই ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আলোকচিত্রী ও আইনজীবী তানভীর রিফাতের সঙ্গে। শরদিন্দু নিয়ে একসাথে কাজ করার মাধ্যমে তাদের বন্ধুত্ব যেমন শক্ত হয় তেমনি তৈরি হয়ে যায় একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা। যেহেতু দুজনই একসঙ্গে কাজ করতেন তাই পরিবারও কম সময়ের মধ্যে জেনে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কের কথা।

সুরভী বলেন, ‘প্রেমের সম্পর্ককে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যেতে আমাদের তেমন কোনও ঝামেলাতেই পড়তে হয়নি। কারণ, আমার বাবা-মা সবসময় আমার নিজের পছন্দমতো সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ছিল। আর যেহেতু আমরা একসাথে ব্যবসা করতাম, তাই তাদের আলাদা করে বোঝাতে হয়নি। আমরা আসলে সামাজিকভাবে অনেক কাজ করি সোশাল মডেলিংয়ের মাধ্যমে। আমরা যখন কোনও একটা কাজ অনেককেই করতে দেখি, তখন সামাজিকভাবে সেই কাজটাকে আমাদের গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এই ক্ষেত্রেও অনেকটা সেটাই হয়েছে। আশপাশে যেহেতু অনেকেই প্রেমের সম্পর্কের মাধ্যমে বিয়ে করছে, তাই এটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই আড্ডা দিতে গিয়ে বিভাগের বন্ধুর সাথে জুটি বেঁধে ফেলেন হাসনাইন মাহমুদ। তারা দুজনই প্রেমিক-প্রেমিকা পরিচয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে বিয়ের মাধ্যমে পরিণতি তারা দিয়েছেন। প্রেম করে বিয়ে করা ও পরিবারের মানুষের বোঝাপড়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বর্তমানে ইস্টার্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ‘এখন আসলে বাবা মা সন্তানদের সাথে অনেক ফ্রেন্ডলি। আমাদের প্রেমের কথা দুই পরিবার থেকে আগেই জানতো। আমার পড়াশোনার শেষ দিকে দুই ফ্যামিলিই বললো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফেলতে। তখনও আমি ছাত্র। আগে হয়তো এটা চিন্তাও করতো না অনেকে। এখন বাবা মা চান ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দেই জলদি থিতু হোক।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কৃপাকণা তালুকদারের মা নাজনীন খান মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, ‘মেয়ে বড় হয়েছে। তার নিজস্ব পছন্দ, ভালোলাগা আছে। সেক্ষেত্রে মা হিসেবে মেয়ের পছন্দকে সম্মান করাটাই প্রধান ছিল। আর মেয়ে যাকে পছন্দ করেছে সে নিশ্চিত মেয়েকে ভালো রাখবে এটাই মনে হয়েছিল। আর মেয়ে বা ছেলে নিজের পছন্দ মা-বাবার সাথেই শেয়ার করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ মা-বাবাই ছেলেমেয়ের প্রথম বন্ধু। তাই কৃপার বিয়ের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের আপত্তি ছিল না কারোরই।’

সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেন ভুল না হয়ে যায়, সেজন্য করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সৌমিক কথা বলেন, ‘বিয়ে যেহেতু একটা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক, সেক্ষেত্রে সঙ্গী বাছাইয়ে আমাদের একটু সচেতন হওয়া জরুরি। সবার আগে আসলে নিজের সম্পর্কে জানতে হবে। আপনি কেমন বা আপনার পছন্দ-অপছন্দ কেমন, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা খুবই জরুরি। পরবর্তীতে এর ওপর ভিত্তি করেই আপনার সঙ্গী নির্বাচন করা উচিত। এসব বিষয়ে খুব বেশি তাড়াহুড়ো না করা বা শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো। সঙ্গী ও সাথে তার পরিবার বা সে কেমনভাবে বেড়ে উঠেছে, এসব আপনার সাথে মিলছে কিনা এগুলো একটু ভেবে দেখতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ইদানীং পরিবারগুলো ছেলেমেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে সন্তানের পছন্দকে প্রাধান্য দিচ্ছে, যা একটি ভালো দিক। প্রাধান্য দিচ্ছে মানে পছন্দের কেউ আছে শুনলেও একেবারে বেঁকে বসছে না। সেই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

পছন্দের প্রস্তাব মানেই একেবারে সম্মত হবে, তারও কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। সচেতন অভিভাবক হিসেবে যেকোনও পিতামাতা তার সন্তানের পছন্দকে যাচাই বাছাই করবে। তাদের নিজস্ব মানদণ্ডে গ্রহণ করার মতো হলে করবে, নয়তো আপত্তি জানাবে। সন্তানের কাজ হবে, তাদের পছন্দকে বিয়েতে রূপান্তর করতে চাইলে, পরিবারের মানসিকতাকে বোঝা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের প্রস্তুত করা। যেহেতু প্রেম করা আর বিয়ে করে সংসার করা সমার্থক নয়, অভিভাবক সন্তান দুই পক্ষকেই বিষয়টি অনুধাবন করে সে অনুযায়ী নিজেদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কঠোর মনোভাব পোষণ করলে তা কারোর জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।’


Link copied