মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অধিকার বনাম কর্তব্য - পুলক ঘটক

Anweshan Desk

Anweshan Desk

১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১০:৫৬ এএম


মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অধিকার বনাম কর্তব্য - পুলক ঘটক

সত্য হোক আর মিথ্যাই হোক, সেগুলো প্রকাশ করা আমাদের মত প্রকাশের অধিকার কিনা?

 

জন্ম ও যোনির ইতিহাস বইয়ে লেখক জান্নাতুন নাঈম প্রীতি কিছু মানুষের সঙ্গে তার নিজের জীবনের গল্প প্রকাশ করেছেন। চলচিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সঙ্গে নিজের দৈহিক সম্পর্ক এবং সেলিমের কিছু যৌনসঙ্গীর নাম তিনি প্রকাশ করেছেন। সেলিম যেসব মেয়ের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার গল্প প্রীতিকে বলেছিলেন, সেই গল্পগুলো কি তিনি প্রীতিকে জনসমক্ষে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলেন? তিনি যদি সে অনুমতি তাকে দিয়েও থাকেন, যে মেয়েদের কথা তিনি বলেছেন সেই মেয়েরা কি তাকে তা প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন? অথবা আইন কি প্রীতিকে এসব প্রকাশের অনুমতি দেয়? ধরে নিলাম আইন সে অনুমতি না দিয়ে আমাদের কন্ঠ রোধ করতে চায়; রাষ্ট্র আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। কিন্তু নৈতিকতা বা আমাদের সাধারণ নীতিবোধ কি আমাদেরকে সে অধিকার দেয়?

প্রীতির যৌনগল্পগুলো পরে আনছি। আগে ধরুন আমি পুলক ঘটক নিজে এই সমাজের পাঁচজন নারীর নাম উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের গল্প লিখতে চাচ্ছি। তাদের স্বামী ও সংসার আছে জেনেই আমি হয়তো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছি। এখন আমি সেই পরকীয়া পার্টনারদের নিয়ে লিখলে তারা হিউমিলিয়েটেড হতে পারে এবং তাদের সংসারও ভেঙে যেতে পারে। তবুও আমি তাদের কথা প্রকাশ করব; বিছানায় থাকার সময় তারা আমাকে অন্য যাদের সম্পর্কে বলেছেন সেগুলোও বলব! সেই গল্পের সত্য-মিথ্যা কে নিরুপণ করবে? সত্য হোক আর মিথ্যাই হোক, সেগুলো প্রকাশ করা আমার মত প্রকাশের অধিকার কিনা? সাংবাদিকতায় বা লেখক হিসেবে আমি আমার নিজের জীবনের সঙ্গে অন্যের গল্প প্রকাশ করতে পারি কিনা? আমি যদি প্রকাশ করি, তখন কোনটা মূল বিবেচ্য হবে? আমি যা লিখেছি তা সত্য না মিথ্যা - সেটা মূল বিবেচ্য হবে? নাকি এসব লেখার অধিকার ও ন্যায়পরায়নতা মূল বিবেচ্য হবে?

সাংবাদিকতা ও লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক নতুন নয়। পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির একান্ত জীবনের গল্প, ছবি, ভিডিও বা কোনো শিল্পীর নিজস্ব কল্পনায় আঁকা ছবি প্রকাশ নিয়ে বড় বড় বিতর্ক অতীতে তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশেই সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের সাথে বিভিন্ন নারীর সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন সময় যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল এবং আজও যে আলোচনা হয় – সেগুলো আইনগতভাবে সঠিক কিনা, ন্যায্য কিনা এবং প্রেসফ্রিডমের বস্তু কিনা? এ বিতর্কের শেষ সিদ্ধান্ত কি? স্বৈরশাসক এরশাদ বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের গল্প প্রকাশ করলে ঠিক আছে, কিন্তু কেউ আমারটা লিখলে তা ঠিক নেই – এ সিদ্ধান্তই বা কোন অধিকারে নেব?

প্রসঙ্গের ধারাবাহিকতাহীন এলোমেলো কথাবার্তায় ভর্তি এই বইটিকে আমার মানসমৃদ্ধ রচনা মনে হয়নি। তবে এখানে অধিকাংশ কথাই মানুষের নিত্যদিনের আলোচিত সত্য, যা বহুমানুষের প্রায় মুখস্ত বাক্য; এবং অধিকাংশ অন্ধ জনতার উপেক্ষিত সত্য। এই নির্দয় সত্যের প্রকাশকে আমি শ্রদ্ধা করি। কবি নজরুলের কথা ধার নিয়ে, "অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস"কে সালাম জানাই। প্রীতি আপনাকে সেলাম।

বইটিতে আমার যা খারাপ লেগেছে তা হল ”ব্যক্তিবিদ্বেষ”। যার প্রতি প্রীতির কোনো কারণে বিদ্বেষ আছে তিনি তারই যৌনজীবন ঘেটেছেন। যার প্রতি তেমন বিদ্বেষ নেই, তার কথা গোপন করেছেন।

সদ্য প্রকাশিত বইটির ৫২ পৃষ্ঠায় “সেক্স স্টোরি” নিবন্ধ শুরুর বাক্যটি হল, “সেই ষোলো বছর বয়সে প্রথম রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্ট মোড়ে দাঁড়িয়ে চুমু খেয়েছিলাম এক প্রেমিককে।” সেই প্রেমিকটির নাম প্রকাশ করেননি প্রীতি। তার প্রতি কোনো রাগ নেই বলেই তিনি তাকে সমাজের সামনে এনে বিব্রত করতে চাননি। তার সঙ্গে প্রীতির প্রেম জীবনের ইতি কিভাবে ঘটল, ছেলেটি তাকে প্রতারণা করেছে নাকি তিনি তাকে ঠকিয়েছেন – ইত্যাদির কোনো উল্লেখ বইয়ে নেই। জীবনের এই অংশটি লেখক প্রাইভেট করে রেখেছেন। এই প্রাইভেট রাখা এবং পাবলিক করার অধিকার বা কর্তব্যই আজকের মূল আলোচ্য।  

এই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “অতিমাত্রায় কৌতুহলের কারণেই সম্ভবত শরীরের সাথে শরীরের অদ্ভূত যোগাযোগের ভাষা আমার কাছে ধরা দেয় যখন স্কুল শেষ করে কলেজে উঠব। সেই সময়ই প্রথম আমার গোপন প্রেমিকের সামনে আমি কাপড় খুলে দাঁড়াই।”

প্রীতি তার এই গোপন প্রেমিকের নামও গোপন রেখেছেন। কেন তার নাম প্রকাশ করেননি? কোনটা প্রাইভেট থাকবে, আর কোনটা পাবলিক হবে – কিসের ভিত্তিতে তিনি নির্ধারণ করেছেন?

বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয়েছে “দেশ-কাল-পাত্র” নামে একটি নিবন্ধ। সেখানে লিখছেন, “দেশে থাকতে ২০১৯ সালের দিকে যে ফ্রেঞ্চ আলজিরিয়ান এক ছেলের সাথে সামান্য সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ইন্টারনেটের সুবাদে।” সেই বিদেশী ছেলেটিরও পরিচয় প্রকাশ করার প্রয়োজন তিনি মনে করেননি। কারণ তাতে কোনো লাভ নেই। ঐ তথ্য কোনো সেনসিটিভিটি ক্রিয়েট করবে না।

তার সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “আমাকে চমকে দিয়ে সে একদিন সোনারগাঁও হোটেলের স্যুটু বুক করে ফেলল! …… সে মূলত ভাবছে বাংলাদেশ নামের একটা গরিব দেশের মেয়ে তার সাথে এমন সুন্দর করে কথা বলছে কারণ ওরা গরিব, ওদের জন্য ইউরোপ-আমেরিকা মানে বিশাল ঘটনা! আর তার আছে টাকা। ফলে খুব সহজেই বশীভূত করা যাবে! কিন্তু তার মিথ্যা ধারণাকে ভেঙে দিয়ে বিদায় জানালাম তাকে।”

আমার কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি প্রীতি তাকে এভাবে বিদায় জানিয়েছিলেন। কেন আমি তাকে বিশ্বাস করব? তিনি কি বিশ্বাসযোগ্য – একজন লেখক হিসেবে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে বা মানুষ হিসেবে? আমার ধারণা প্রীতি সেই বিদেশী যুবককে এভাবে বিদায় দেওয়ার কথা লিখেছেন একারণে যে, তিনি টাকার জন্য বা কোনো ফায়দা নেওয়ার জন্য কারও বিছানায় যেতেন – এটা যাতে প্রতিয়মান না হয়। অন্তত: তিনি প্রফেশনাল যৌনকর্মীদের চেয়ে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তারমানে কৌতুহলী হয়ে অথবা ফ্যান্টাসি টাইপের অথবা প্রতিশোধমূলক অথবা পুরুষদের প্রতি ঘৃণাসূচক যৌনজীবনের প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে। এগুলো তার চোখে ভাল জিনিস। কিন্তু পেশাদার যৌনকর্মীরা যেহেতু টাকার বিনিময়ে শরীর ভাড়া দেয়, তাই তাদেরটা খারাপ!  

প্রীতি কয়েক বছর আগে লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদের ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ এনেছিলেন। সে সময় ইমতিয়াজকে ডিফেন্ড করার দায়ে ঐ ৬ জন নারীর প্রতি তিনি রীতিমতো বিষোদগার করেছেন। তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ”হিংসুক নারীটি ঈর্ষায় মাখামাখি হয়ে গালাগাল দিতেও ছাড়েনি আমাকে। আমার প্রাক্তন ইতিয়াজের পক্ষ নিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই তিরস্কার করতে ছারেনি। এমনকি এক স্থপতি বন্ধুর কাছে জেনেছিলাম এই নারীটি কী চমৎকার সংগমপটু। কে জানে হয়তো ইমতিয়াজকে কামনাই করত সে, সেই কারণেই এই পক্ষপাত।” প্রীতি সেই নারী সাংবাদিকের নাম লিখেছেন কিন্তু তার স্থপতি বন্ধুর নাম লেখেননি। লেখকের উদ্দেশ্য পরিস্কার এবং প্রকাশের সততা প্রশ্নবিদ্ধ।

ইমতিয়াজের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু হৃদয়ের ছিল, না কি সেটাও বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েছিল এই বইয়েও তিনি তা পরিস্কার করে বলেননি। ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে তার মূল অভিযোগ কি তাও খানিকটা অস্পষ্ট। তবে তার প্রতি প্রীতির প্রচুর রাগ আছে বোঝা যায়। তার বিষয়ে যখন বলেছেন, “মিথ্যে কথা বলে প্রেম করা, মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া, স্বপ্ন দেখিয়ে সম্পর্ক করাও প্রতারণা হতে পারে,” – এই বক্তব্য ঠিক আছে । এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। ইমতিয়াজ হয়তো এটা করেছেন। তবে তিনি প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তাকে ধর্ষণের মতো অপরাধ করেছেন, এমন অভিযোগ প্রীতি আনেননি।

যতটুকু তিনি লিখেছেন তাতে বলতে পারি, ইমতিয়াজ যা করেছেন তা অন্তত তিন জনের সঙ্গে প্রতারণার শামিল: ১. নিজের সঙ্গে, ২. প্রীতির সঙ্গে এবং ৩. স্ত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তবে এই প্রতারণার শতভাগ অংশিদার প্রীতি। তিনি জেনে বুঝে একজন “মধ্যবয়সী” বিবাহিত লোকের সঙ্গে এই সম্পর্কে জড়িয়েছেন। প্রীতিকে দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই। যে ছয়জন নারী সে সময় ইমতিয়াজের পক্ষে লেখার কারণে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তারা কে কি লিখেছিলেন আমার পড়া হয়নি। কিন্তু আমি এখানে কথাগুলো যেভাবে বলছি, তারাও যদি সে কথাই বলে থাকেন তবে প্রীতি হয়তো আমার প্রতিও একইভাবে ক্ষুব্ধ হবেন; যা ইচ্ছা লিখতেও পারেন। তবে আমার নিশ্চিত প্রত্যয়, ইমতিয়াজ প্রীতির সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে যে অপরাধ করেছেন, প্রীতিও সমপরিমাণ করেছেন। পরবর্তীতে ইমতিয়াজের প্রতি এবং তার পরিবারের প্রতি তার চেয়েও অনেক বেশি অন্যায় প্রীতি করেছেন। প্রথমে গোপনে অন্যায় করেছেন। পরে সেটা প্রকাশ্যে জনগণের কাছে বলেছেন –আপনার সাধুতা এবং অপরের পাপ সমাজকে দেখাতে চেয়েছেন।

প্রীতি নিশ্চয় বেশ্যা নন। তবে যৌনকর্মীদের প্রতি তার ঘৃণা থাকা উচিত নয়। মানুষ স্ত্রী ঘরে রেখে যৌনপল্লীতে যৌনতৃপ্তির জন্য যায়। তাদের বিশ্বাস থাকে, যৌনকর্মীরা তাদের গোপন কর্মের কথা প্রকাশ করে দেবেন না। তাদের কর্মের জন্য তাদের স্ত্রী এবং আত্মীয় স্বজনকে কষ্ট দেবেন না। ইমতিয়াজ টাকা দিয়ে এরকম খরিদ্দার হননি। প্রীতির বক্তব্য অনুযায়ী তিনি মিথ্যা কথার ফুলঝুরি সাজিয়ে অসঙ্গত সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। এরকম কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। ইমতিয়াজের সাথে প্রীতির কাজও গ্রহণযাগ্য নয়। তবে তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজের চেয়ে প্রীতির ‘বাক্যের পর্ণগ্রাফি’ বেশি অগ্রহণযোগ্য কিনা? তিনি তার গোপন বিছানাকে বারবার জনসমক্ষে এনে দেখিয়েছেন। কখনই আদালতে গিয়ে অভিযুক্তদের বিচার চাননি।

৬৩ পৃষ্ঠায় “মালিকানা” নিবন্ধে প্রথম বাক্য, “তুমি একজন নারীবাদী! এই কথাটা যে জীবনে আমাকে প্রথমবারের মতো বলেছিল সে আমার বহু প্রাক্তনদের মধ্যে একজন।” কিন্তু তিনি এই প্রাক্তনটির নাম প্রকাশ করেননি, যেমন প্রকাশ করেননি তার অন্যান্য অনেক প্রাক্তনের নাম। এই ভদ্রলোকের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রীতি বারবার বলেছেন “আমার প্রাক্তন প্রেমিকটি”; কিন্তু নাম প্রকাশ করেননি। এ তার স্ববিরোধিতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। যার প্রতি কোনো কারণে তার রাগ আছে তিনি তার নাম লিখেছেন। যাদের নাম প্রকাশ করলে সমাজে বড় কোনো আলোচনা হবে না, তাদের নামও তিনি প্রকাশ করা প্রয়োজন মনে করেননি। যাদের টার্গেট করলে সমাজে আলোচনা হবে এবং তার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাও চরিতার্থ হবে, শুধু তাদের নাম তিনি লিখেছেন।

আমার মনে হয়েছে, এই লেখক এখনো নিছক একজন মানসিক রোগী, যে রোগ একসময় তার থাকবে না। বোঝা যায়, ছোটবেলা থেকে নিজের বাবার প্রতি তার যে ঘৃণাবোধ তৈরি হয়েছে, সেটাই তার অন্তর সত্ত্বাকে বিষাক্ত ও বিকৃত করে রেখেছে। তাকে বানিয়েছে প্রতিহিংসা পরায়ন। প্রীতির প্রতিভা আছে। মানসিক চিকিৎসায় মানুষের প্রতি তার ঘৃণা দূরিভুত হলে একদিন তিনি ভাল লেখক হবেন। বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে তার লেখার প্রতি ছত্রে প্রেম নয়, ঘৃণা বেরিয়েছে।  

বইয়ের ১১৫ নম্বর পাতায় “নির্বাসিত” নিবন্ধে তসলিমা নাসরিনের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ”তার দ্বিচারিতা, ইসলামোফোবিয়া, পক্ষপাত নিয়ে সমালোচনাও করেছি।” আমি অবাক হয়েছি। প্রীতি, আপনি তসলিমার সমালোচনা করেছেন “ইসলামোফোবিয়া”র জন্য। অথচ আপনার এই বইটি বলে দিচ্ছে আপনি নিজেই ইসলামোফোবিক। শুধু ইসলামোফোবিয়া নয়, আপনার ধর্মফোবিয়া আছে — এ সমালোচনা যে কেউ করতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এই সমাজের বহু মানুষ ধর্মফোবিয়া বা ধর্মভীতিতে আক্রান্ত। ধর্ম নিয়ে যেসব ভীতিকর কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত চলছে তা দেখে ধর্মভীতি তৈরি না হওয়াই আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। সুতরাং প্রীতির ধর্মফোবিয়া নিয়ে আমার সমালোচনা নেই। আমার সমালোচনা হল, তিনি কিভাবে অন্য কারও ”ইসলামোফোবিয়া” নিয়ে কথা বলতে পারেন? প্রীতির ভাষায় তসলিমার “দ্বিচারিতা, ইসলামোফোবিয়া, পক্ষপাত” এই তিনটি জিনিসই প্রীতির বইয়ে প্রকট।

৭৬ পৃষ্ঠায় এসে “আমার পুরুষেরা” নিবন্ধে প্রীতি যা বলেছেন তার একটি অংশ এখানে হুবহু তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন:  

নিউ ইয়ার পার্টিতে মদ খেতে খেতে আমার জার্মান বন্ধু নিনা গল্পচ্ছলে জিজ্ঞেস করেছিল - আমার জীবনে পুরুষের সংখ্যা কত?

আমি শ্যাম্পেনের গ্রাসে চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলাম - এতগুলো যে মদ খেতে খেতে সবার নাম মনে করা সম্ভব না।”

তাও আন্দাজ করলে?”

- এই ধরো ত্রিশ -পঁয়ত্রিশ!

সে ছোট্ট শিস দিয়ে বলল, -- কিছু মনে না করলে জানতে পারি, বয়স কত তোমার?

- ছাব্বিশ হতে যাচ্ছি!

সে নিজের গ্লাসের অবশিষ্ট শ্যাম্পেনটুকু পেটে চালান করে দিয়ে বলল - সে কি, বয়সের চেয়ে বেশি!

আমি হেসে যোগ করলাম - আর এখন ভালো মেয়ের মতো প্রেম করছি।

সে শ্যাম্পেইন খালি হওয়া গ্লাসে লাল টকটকে ওয়াইন ভরে এনে ঘোষণা দিল - টোস্ট ফর ইউর লাভ লাইফ!

আমার লাভ লাইফ বা প্রেম জীবনের প্রতি শুভকামনার ঘোষণা দেওয়া নীনার কাছে জানলাম - ও নিজে এক ওপেন রিলেশনশিপে। ছেলেটির নাম - লুই। …….

ইউরোপে আসার আগে ওপেন রিলেশনশিপের নাম শুনলেও এ কখনোই দেখিনি আমি স্বচক্ষে। দেশে যেসব প্রেমকে ‘ওপেন রিলেশন’ বলে জেনেছি সেগুলো ছিল অতি অস্বাস্থ্যকর। - বেশিরভাগ সময়িই বউ, প্রেমিক ও প্রেমিকার ত্রিমুখী সংঘর্ষ! এ দিকে বইয়ে পড়েছি ফরাসি দার্শনিক জ পল সাঁত্র আর নারীবাদের পুরোধা সিমন দ্য ব্যুভোয়া ওপেন রিলেশনশিপে ছিলেন। দুজন দুজনকে ভালোবাসতেন। কিন্তু শুয়েছেন বহুজনের সাথে। আর দশটা সম্পর্কের মতো রাগ-অভিমানও করেছেন। আবার ঠিক গিয়ে মিলেছেন। এমনকি এখনও দুজন শুয়ে আছেন প্যারিসের বিখ্যাত কবরস্থান ‘মোপারনাস সিমেট্রিতে একই কবরের ভেতর। কেবল এটুকুই।

কিন্তু জলজ্যান্ত দু’জন মানুষ এমন সম্পর্কে আছ, তা আমার কাছে কৌতূহল জাগানিয়া। তাই লুই ও নীনা জুটিকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি না। এমনই অবিচ্ছেদ্য ওরা।”

 

ওপেন রিলেশনে ও এর সততায় প্রীতি মুগ্ধ হয়েছেন। তবে কবি হেলাল হাফিজের সঙ্গে সম্পর্কের একরকম বর্ণনা দিয়ে শেষে প্রীতি লিখেছেন,

“আহা হাফিজ, তুমি যদি জানতে! আমি যাদের ঘৃণা করেছি তাদের প্রতি আমার প্রেমের কমতি ছিল না। কিন্তু ঘৃণা, সো তো ভালোবাসারই বিপরীত, মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। আমি কি ইমতিয়াজকে ভালোবাসিনি? কিংবা আমার প্রথম প্রেমিক উত্তমকে? কিংবা সাজিদকে অথবা অভীকে? কিংবা আর তাদেরকে, যারা আমাকে ভালোবাসার বাণী শুনিয়ে প্রতারণা করেছে, মিথ্যে বলেছে। আমি জেনেছি, ভালোবাসা মানে কেবল শরীর খেলাই। মন সেখানে কী কাজে লাগে?”

তিনি যখন জেনেছেন, “ভালোবাসা মানে কেবল শরীর খেলাই। মন সেখানে কী কাজে লাগে?” এবং তিনি যখন “ওপেন রিলেশনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল – তখন তার ক্ষনিকের প্রেমিকদের প্রতি “ঘৃণা” জন্মানোর বিষয়টি স্ববিরোধিতা হয়ে যায়।

এখানে প্রীতি কয়েকজন প্রাক্তনের নাম উল্লেখ করেছেন বটে; তবে তাদের পরিচয় অগোচরে। প্রীতি এরপর বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও লেখকের নাম লিখেছেন যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক যৌনতা পর্যন্ত গড়ায়নি, তবে তারা তার দিকে হাত বাড়িয়েছিল।

লিখেছেন, “আরেকজনকে চিনতাম, নাম নওশাদ জামিল। লোকটি বিয়ে করেছে। কিন্তু নিরিবিলিতে গোপনে তার দেখা করতে হবেই অন্য মেয়ের সাথে। যার কথা স্ত্রী জানবে না। এ বড় কঠিন লীলাময় রোগ।”

প্রীতির এই বাক্যগুলো অত্যন্ত সত্য। তিনি লিখেছেন, ”এই লোলুপের দল বাদেও একে একে আমার জীবনে এসেছিল যে প্রেমিকেরা তাদের দেখে, প্রেম বলে কিছু নেই জেনে চেষ্টা করেছিলাম এক নতুন জীবন কিছুদিনের জন্য বেছে নিতে, যেখানে হাত বাড়ালেই সঙ্গী, হাত ছুঁলেই প্রেম!

সেই ধারাবাহিকতায় শুয়েছিলাম গিয়াসউদ্দিন সেলিমের সাথে। শুয়ে শুয়েই সেলিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কতগুলো মেয়ের সাথে শুয়েছ তুমি? সে উদাস গলায় বলেছিল- পঞ্চাশের ওপরে হবে। যাদের সাথে শুয়েছি তাদের অধিকাংশের নাম ভুলে গিয়েছি!

অভিনয় জগতের বেশ কয়েকজন নারীর নাম প্রীতি এই জায়াগায় লিখেছেন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রসঙ্গে “সেলিম সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেছিল – ভালোবাসা না প্রীতি, একসাথে থাকাটা একটা অভ্যাস।”

এরপর প্রীতি লিখছেন,

“সেলিমের এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে আজও। প্রচণ্ড কামুক ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অসৎ হলেও সে অবলীলায় দীনতা-হীনতা স্বীকার করতে জানে।”

প্রীতির পরবর্তী বাক্যগুলোতে যাওয়ার আগে ঠিক এই জায়গায় তার কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার নিজের সম্পর্কে কি বলবেন? আপনি কি সম্পর্কের ক্ষেত্রে চুড়ান্ত সৎ? তাহলে আপনার অভিযোগ কার প্রতি?

সেলিমকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন,

“ধরো তুমি একদিন জানলে প্রতিটি নায়িকার সাথে তোমার শয়নের ইতিহাসের মতো তোমার বউয়েরও এক আলাদা জগৎ ও ইতিহাস আছে কামের। তখন তুমি কী করবে তা জেনে? সে বলল – কষ্ট পাব। চাইব সে যা ইচ্ছে করুক, আমাকে না জানিয়ে করুক। তাতে সুখী হবো!

আমি বলেছিলাম- আহারে পুরুষ! যা তুমি নিজে করছ তা তোমার স্ত্রীটি করলেই সমস্যা?”

প্রীতির এই প্রশ্নটি কিন্তু যথার্থ এবং গুরুত্বপূর্ণ। যাপিত জীবন থেকে তুলে আনা এ এক বাস্তব চিত্র। আমি নিজেও নারী অধিকারের প্রশ্নে বিভিন্ন লেখায় বহুবার এধরণের প্রশ্ন সামনে এনেছি। পুরুষরা তোমরা যা কর, ঠিক সেটাই নারীরা করলে তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। যেটাতে তোমার অধিকার ভাব – যা তোমার ক্ষেত্রে ঠিক আছে – সেটাই নারীর ক্ষেত্রে তুমি অপরাধ ভাব। সকল ক্ষেত্রে নারীকেই তোমরা অপরাধী ভাব। এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই নারীর প্রতি যতপ্রকার অবিচার ও খবরদারি চালানো হয়। এই সত্যকে স্বীকার করেই এবার প্রীতিকে বলছি, “আহারে নারী! যা তুমি নিজে করছ তা তোমার পুরুষটি করলেই সমস্যা?”  

বইটির এক পর্যায়ে এসেছে চলচিত্র পরিচালক সেলিমের সহকারী শিপ্রা দেবনাথের কাহিনী। এই শিপ্রা মেজর সিনহা হত্যা মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি গুরুত্ব নাম। ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ককে সিরিয়াসলি না নেয়ার জন্য শিপ্রার পরামর্শ শেষে প্রীতি লিখছেন, “অবশ্য এতদিনে আমি প্রেমের ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন হয়েছি। আমার এখনকার সঙ্গীর সাথে তখনও দেখা হয়নি। সেই সময় পর্যন্ত আমার শেষ প্রেমিক অভীর সাথে ব্রেকাপ করেছি। ব্রেকাপের আগে তীব্রভাবে আঘাত পেয়েছি যখন জেনেছি অভী আরেকটা প্রেম করছে।”

“আজও মন বসতে এবং উঠে যেতে যাদের সময় লাগে না তাদের ভয় পাই। পুরুষদের আমি সহজে বিশ্বাস করতে পারি না অতীতের নানান তিক্ত অভিজ্ঞতায়,” প্রীতির এ বক্তব্য দুর্বোধ্য নয়।

কিন্তু মিস প্রীতি, আপনার কারণে কোনো পুরুষ যদি নারীদের প্রতি বিশ্বাস হারায়? “মন বসতে এবং উঠে যেতে যাদের সময় লাগে না তাদের” আপনি কেন ভয় পান? অপনি তো ওপেন রিলেশনশীপে শ্রদ্ধা রাখেন! ওপেন রিলেশনশিপে শ্রদ্ধাশীল একজন মানুষের ক্ষণিকের সম্পর্কের প্রতি অশ্রদ্ধা থাকবে কেন? এই মনস্তত্ত্বের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমি হয়তো জানি না বলেই প্রশ্নটা করছি।

প্রীতি তার বইয়ে সেলিমের “অ্যাসিট্যান্ট” শিপ্রা দেবনাথের যৌনজীবন প্রসঙ্গ বিশেষভাবে নিয়ে এসেছেন। সাথে এনেছেন পুলিশের কথিত এনকাউন্টারে নিহত মেজর সিনহার গোপন চরিত্র। তিনি বইটিতে এমন কিছু তথ্য (অথবা নিছক গল্প) প্রকাশ করেছেন, যা সিনহা মার্ডারের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিভিন্ন এজেন্সির কঠোর নজরদারিতে থাকা অবস্থায় শিপ্রার আবারও গর্ভবতী হওয়ার মতো সংবেদনশীল তথ্য এবং বিবৃতি অনুযায়ী অল্পদিন আগে নিহত সিনহার দ্বারাই গর্ভবতী হওয়ার চাঞ্চল্যকর কথা তিনি লিখেছেন।

তিনি কেন এসব বলেছেন? তিনি কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিপ্রাকে ফাঁসাতে চেয়েছেন? কিন্তু ঘটনা সত্য হলে এগুলো তো গুরুতর – যা প্রকাশের অন্যরকম প্রেক্ষিত ও প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। একটি বিচারাধীন হত্যা মামলা – যাতে অভিযুক্তের ফাঁসির রায় হয়েছে –  তথ্যগুলো সে মামলার ভিকটিমের বিষয়ে, মামলার স্বাক্ষীর সঙ্গে ভিকটিমের সম্পর্ক বিষয়ে। এ তথ্য এমন একজন মানুষের গোপন জীবন সম্পর্কে, যিনি কিনা রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ বিশ্বস্ততার দায়িত্বে ছিলেন। দেশের সরকার প্রধানের নিরপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মেজর সিনহা। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্যে সংবেদনশীল বটে। তথ্যগুলো সত্য হলে প্রীতি তা বলবেন না কেন? আবারও প্রশ্ন ওঠে, যদি তিনি বলবেন, তবে দেরীতে কেন? বিচারিক আদালতে মামলা শেষ হওয়ার পর কেন?

বলার বা প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আমার আরও একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হল, কোনটি প্রাইভেট থাকার বিষয় এবং কোনটি পাবলিক করার বিষয়? কিছু জানার পর তা পাবলিক করে দেওয়ার দায়িত্ব অথবা প্রাইভেট হিসেবে রেখে দেওয়ার দায়িত্বের মধ্যে ফারাক বুঝতে চাই। পাশাপাশি একে দায়িত্ব হিসেবে দেখব, নাকি অধিকার? তথ্য প্রকাশ নিয়ে অধিকার বনাম কর্তব্যের প্রশ্ন। আলোচ্য ঘটনার সঙ্গে একাধারে রাষ্ট্রের গুরুত্ব এবং একজন ব্যক্তির প্রাইভেসি তথা ব্যক্তিগত গোপনাীয়তা রক্ষার গুরুত্ব এবং ব্যক্তি মানুষের বন্ধুত্বের প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব জড়িয়ে আছে।

 

আসুন সাংবাদিকতার নিরিখে কিংবা একজন লেখকের প্রকাশের স্বাধীনতার নিরিখে এ বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ভাবি। ধরুন, শিপ্রা দেবনাথ নামক আলোচ্য মেয়েটি আমার ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত বন্ধু। আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক – এটাও সত্য। এখন সিনহা হত্যা মামলার চাক্ষুষ স্বাক্ষী সেই শিপ্রা মামলা চলমান থাকা অবস্থায় একদিন ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বললেন, “পুলক, আমি না প্রেগন্যান্ট!”

আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি— কিভাবে? এই বাচ্চার বাবা কে?

ও বলে- “সিনহা”!

এই যে তথ্যটি আমার কাছে আসল, এ নিয়ে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার কর্তব্য কি হবে? গোপন রাখা, নাকি প্রকাশ করা? এখানে অনেক বিষয় জড়িত। প্রথমত, শিপ্রা আমাকে যে কথাটি বলেছে, তা বন্ধু হিসেবে বলেছে; ব্যক্তিগতভাবে বলেছে। আমার বন্ধুর প্রতি আমি বিশ্বস্ত থাকব, নাকি অবিশ্বস্ত হব? আমি কি তার গোপন কথা ফাঁস করে দেব? একজন মানুষ হিসেবে বা বন্ধু হিসেবে আমার কর্তব্য কি? আরেকদিকে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার কর্তব্য কি হবে?

আমি যদি এই তথ্যটি প্রকাশ করতে চাই, তাহলেও কি আমি যে মিডিয়ায় কাজ করি তারা প্রকাশ করবে? শিপ্রা আমাকে কথাটি বলেছে, তার কোনো রেকর্ড নেই – এরকম তথ্য কোনো দায়িত্বশীল মিডিয়া আমার মুখের কথায় নির্ভর করে প্রকাশ করবে না। আমাকে আরও ভালভাবে বিষয়টি জানতে বলবে, নিশ্চিত হতে বলবে এবং প্রমাণ সংগ্রহ করতে বলবে। আবার অতি উৎসাহী কোনো মিডিয়া হয়তো বিষয়টি প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারবে না। কারণ একটি তথ্য প্রকাশ করার অনেক কৌশল থাকে। সরাসরি উল্লেখ না করে, গল্পের ছলে এবং রূপকের ব্যবহারে অনেক কৌশলগত তথ্য জ্বলজ্বলে করে প্রকাশ করে দেয়া যায়। সে যাই হোক, এখন যদি শিপ্রার এই কথিত প্রেগন্যান্সি নিয়ে অধিকতর তথ্য জানতে চাই, তবে তা আমার বন্ধুর উপর অনৈতিক গোয়েন্দাগিরি হয়ে যায় কিনা? তাহলে আমি আমার বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকলাম কিনা?

আবার ধরুন, আমি তদন্ত করে বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। এরপরেও আমি আমার বন্ধু শিপ্রার অনুমতি ছাড়া তা প্রকাশ করতে পারি কিনা? একদিকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আরেকদিকে পেশাদারিত্বের সততার প্রশ্ন। এর সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার প্রশ্নও জড়িয়ে আছে। কারণ ঘটনাটি প্রকাশের সাথে সাথে সিনহা হত্যা মামলা নিয়ে আলোচনা ও তদন্ত একটি নাটকীয় মোর নেবে। প্রীতির মেডিকেল রিপোর্ট এবং গর্ভস্থ সন্তান সত্যিই সিনহার কিনা ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া মামলার তদন্তকারিদের দায়িত্ব হয়ে যাবে। এই প্রেগ্যন্যান্সির মধ্যে ঐ হত্যাকাণ্ডের অন্য কোনা যোগসূত্র আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন পড়বে। সিনহার ব্যক্তি জীবন, তার পরিবারে, বাইরে বা অন্য কোথাও তার আরও কোনো শত্রু লুকিয়ে আছে কিনা, তাদের কারও প্রত্যক্ষ বা নেপথ্য সংযোগ এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে কিনা – এসব তদন্তের প্রয়োজন পড়বে। এক লাইনের একটি তথ্য আসলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ; অনেক সত্যের নির্দেশক হতে পারে।

বলছিলাম বন্ধু হিসেবে শিপ্রার গোপনীয়তা রক্ষায় আমার দায়িত্ব বিষয়ে। কিন্তু তার আরও একটি দিক আছে। নিহত হওয়া ব্যক্তির মাধ্যমে গর্ভবতী হওয়ার মতো গোপন তথ্য শিপ্রা আমাকে গোপনে মেসেঞ্জারে বলবে কেন? বিশেষ করে সে যদি জানে আমি একজন সাংবাদিক, লেখক বা ব্লগার? সে কি আসলেই চাচ্ছিল তার এই তথ্য প্রকাশ করা হোক, যা সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছিল না? সেক্ষেত্রে কি একজন লেখক হিসেবে প্রীতির জন্য বিষয়টি তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করা দায়িত্ব হয়ে যায়? আমার এই প্রশ্ন সকল পাঠকের প্রতি।

প্রীতি হয়তো কখনই বাংলাদেশের আদালতে স্বাক্ষ্য দিতে আসবেন না। অথচ তার বইয়ে উল্লেখিত তথ্য সিনহা মার্ডার কেসের সত্য উন্মোচনের জন্য আদালতের ইনকোয়ারির প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করেছে। এসব নিয়ে জনসমাজে গুঞ্জন, বিভ্রান্তি ও বিশ্বাসহীনতা বিরাজ করা ভাল নয়। বিষয়টি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন।

শিপ্রার মুখ দিয়েই প্রীতি এরকম আরও কয়েকজন নারী ও পুরুষের নাম বলিয়েছেন। এই মানুষগুলো হয়তো তাকে বিশ্বাস করে তাদের নিজেদের জীবনের কাহিনী বলেছিল। কিন্তু একজনও তাকে সেসব কাহিনী বই আকারে প্রকাশের অনুমতি দেয়নি। অথবা এমনও হতে পারে, প্রীতি তাদের কারও সম্পর্কে মিথ্যা কথা লিখেছেন। তাদের বিশেষ কারও প্রতি হয়তো তার রাগ ছিল। এ কারণে হয়তো দুটি সত্য কাহিনীর সঙ্গে তিনি সেই ব্যক্তির নামও জুড়ে দিয়েছেন। এ কিন্তু আমার অনুমানের কথা, যা প্রমাণ সাপেক্ষ।

আসলে আমি যা ইচ্ছা তাই করব, একে স্বাধীনতা বলে না। এর সঙ্গে দায়িত্বশীলতা প্রাসঙ্গিক। লেখক হিসেবে প্রীতির দায়িত্বশীলতা নি:সন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি `চুজ এন্ড পিক’ করেছেন। নিজের যৌন জীবনের প্রায় ৩৮ জন পার্টনারের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নাম তিনি প্রকাশ করেছেন – এবং অবশ্যই তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে – যাদের প্রতি তার ক্ষোভ আছে। বাকিদের নাম প্রকাশ করেননি। কারও প্রতি তিনি করুণা করেছেন, অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন, অথবা সেখানে তার দুর্বলতা আছে। তার বন্ধুমহলেরই কয়েকজন নারী সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন, যার মধ্যে তার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা স্পষ্ট। অর্থাৎ তার এই বই একজন হৃদয়বান লেখকের মহত্তম প্রকাশ নয়। নিজের সম্পর্কের বাইরে যে মানুষগুলোর যৌনজীবনের কথা তিনি বলেছেন, সেগুলো তার শোনা কথা। তিনি তার পার্টনারের কাছে শুনেছেন। না জেনে তার সম্পর্কে যা লিখেছেন তা নিসন্দেহে অনৈতিকতা। এই অনৈতিকতাকে “প্রকাশের অধিকার” বলার সুযোগ নেই।  

মহুয়া ভট্টাচার্য ভাল লেখক। গত ৪ জানুয়ারী তিনি ফেসবুকে লিখেছেন:

“প্রেমে গদগদ যেকোনো দম্পতির পোস্ট দেখলেই আমার একটু সন্দ হয়!  আমার প্রাক্তন পঞ্চান্নোর্ধ প্রেমিক তাঁর বিবাহ বার্ষিকীতে প্রেমে গদগদ হয়ে কেক কেটে, ছবি তুলে, ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে আমার সাথে দূরপাল্লার বাসে উঠেছিলেন । সেটা ছিলো তাদের ৩২ তম বিবাহবার্ষিকী। আমার জন্ম এবং তাঁর বিয়ে বছর একই সনে। দাম্পত্যের ৩২ বছরও বেঈমানী করার জন্য খুব একটা বেশি সময় নয়, তা আজ বিশ্লেষণ করতে শিখেছি।

তারপর আরো বহু প্রেমিকের তাদের দাম্পত্য সঙ্গীকে নিয়ে প্রেমে গদগদ কবিতা ও ছবিওয়ালা পোস্ট আমি দেখেছি, তাদের লোমহর্ষক (!) প্রেমের গল্প শুনেছি। এরপর আমি কিংবা তারা নতুন করে প্রেমের দিল কি দরোয়াজা খটখটানোর সাথে সাথে তারা সেই লোমহর্ষক প্রেম একপাশে ফেলে আমার সাথে জুটে গেছে। তারপর কোথায় আর সেই প্রেমের গল্প!  অধিকাংশ প্রেমিকের প্রেমের শুরুর পর্যায়ে খুব উদাস ভঙ্গিতে বলতে শুনেছি - আজ দুই বছর / দশ বছর / আঠারো বছর কিংবা বত্রিশ বছর আমি আমার স্ত্রীর সাথে "থাকি না"।

নারীকেও দেখেছি। নারী সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে অতটা লাগামহীন হতে না পারলেও তলে তলে তারাও কম যান না। .......

এতকিছুর পরও এরা, আমরা একসাথে থাকি। মোহে পরে, লোভে পরে, আকাঙ্খা ও প্রত্যাশায়, জীবনকে সহজ করতে, নির্ঝঞ্ঝাট করতে। আমি যতগুলো দাম্পতিকে জরীপ করেছি তাদের মধ্যে প্রেম নাই, ভালোবাসা নাই, সম্মান নাই। হাঁসফাঁস করে। একে অন্যের সাথে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলে। দীর্ঘদিন এক ছাদের তলে থাকে, বিশ্বাসের সাথে কনডম ছাড়াই সেক্স করেন কিন্তু স্বামীর বান্ধবীর সাথে ছবি দেখলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। অথচ তারাই আবার ফেসবুক উড়ায়ে ফেলেন পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করে!

আমি বিয়ে নামক রীতিটাকে প্রহসন হতে দেখছি। খুব দ্রুত হয়তো এই রীতি সমাজ থেকে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।”

মহুয়ার এই লেখায় আমি মন্তব্য করেছিলাম,

“যা লিখেছেন তা সত্য। কিন্তু প্রেমও মিথ্যা নয়। মানুষ বহুগামী হলেও সম্পর্কগুলো মিছে হয় না। সম্রাট শাহজাহানের বহু পত্নী এবং তার চেয়েও বহু নটী ও দাসী ছিল। তার যৌন জীবন ছিল বাঁধাহীন। কিন্তু মমতাজের প্রতি তার যে ভালবাসা, সেটিও সত্য ছিল। মানুষের (নর-নারী উভয়ের) প্রবৃত্তিগত বহুগামিতা আছে; তবে তারা ভালবাসে। বহুগামিতার মাঝে প্রেমও সত্য। সম্পর্কগুলো আপেক্ষিক।”

“জন্ম ও যোনির ইতিহাস” একটি চমৎকার নাম। প্রীতির লেখা যদি বারবার পথ না হারাতো, বিষয়ের প্রতি আরও দৃষ্টিঘন হতো, তবে এ এক অনবদ্য সৃষ্টি হতে পারত। ব্যক্তিগত রাগে, ক্ষোভে, বিকৃত ভাবনায় এই অপরিণত লেখক সত্ত্বার প্রকাশ বিষয়ে আমার শেষ কথা, প্রীতি সেদিন লেখক হয়ে উঠবেন, যেদিন তার মন থেকে হিংসা ও ক্ষোভ উবে যাবে। তিনি প্রেমকে সত্য বলে জানবেন। তিনি সম্ভাবনাময়।

লিখেছেন : পুলক ঘটক ( সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ ) 

জাতীয় থেকে আরও


Link copied