সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও নিরাপত্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৭ টি সুপারিশ ঐক্য পরিষদের
২২ নভেম্বর ২০২২, ২২:২৫ পিএম
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলের কাছে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও ‘তারা বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন’ বলে অভিযোগ জানিয়েছে সংগঠনটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনের কাছে সুনির্দিষ্ট সাতটি সুপারিশও করা হয়েছে।
গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিদর্শন করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল। সে সময় তাঁরা মতবিনিময় সভা করেন। সভায় এসব অভিযোগ ও উদ্বেগের কথা জানান ঐক্য পরিষদের নেতারা।
প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশনের কমিশনার স্টিফেন স্নেক। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হলেন কুর্ট ওয়ার্থমুলার, প্যাট্রিক গ্রিনওয়াল্ট ও টম ব্রাউনস। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
মার্কিন প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। এ সময় তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, রাষ্ট্রধর্ম শুধু ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার বিভাজন টানেনি, ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রচর্চায় ধর্মের অপব্যবহার সাম্প্রদায়িকতাকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দিয়েছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘুরা তাঁদের জীবন, সম্পদ ও নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে তিনি ছয় পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটি লিখিত বক্তব্যে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, দেশত্যাগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী তৎপরতা এবং সংখ্যালঘু পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় উল্লেখ করা হয়।
লিখিত বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলোকে উগ্র, চরমপন্থী ও জঙ্গি হিসেবে পরিণত করা হচ্ছে; যারা শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসই করে না, বরং সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে প্রতিনিয়ত হুমকিও দিচ্ছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের কোথাও ভাস্কর্য স্থাপন করা হলে তারা তা ধ্বংস করে দেবে। তাদের ভাষায়, ভাস্কর্য একটি মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়, যা ইসলামে অনুমোদিত নয় কারণ ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম। এমনকি তারা ব্লাসফেমি অ্যাক্ট প্রণয়নের দাবিও তুলছে।’
সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির চলমান প্রবণতা উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকতে সাধারণভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মের স্বাধীনতা আবারও হুমকির মুখে পড়তে চলেছে। দেশটি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার একটি মহৎ পরিকল্পনার অংশ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এই দেশকে শুধু মুসলিম-জাতিতে পরিণত করেছে। এটি জনসংখ্যার আদমশুমারি থেকে প্রতিফলিত হয়েছে যেখানে দেখা যায় যে ১৯৭১ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ১৯-২০ শতাংশ ছিল, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে ২০২২ সালের আদমশুমারিতে ধীরে ধীরে ৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ২০১৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক মহা সমাবেশ করা হয়। সেখান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে বলা হয়, ‘এই নৃশংসতা’ থেকে মুক্তি পেতে এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বের জন্য তারা কী করবেন, তা একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি জানানো হয়। আমাদের সেই দাবিকে সঠিক বিবেচনা করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও বৈষম্য বিরোধী আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন প্রতিষ্ঠা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাবর্তন আইন দ্রুত বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেছিল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ১৩ মাস বাকি, অথচ সরকার এখনও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি; যা সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য হতাশাজনক।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে :
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাতটি সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে, বৈষম্যমূলক ও সাংঘর্ষিক ধারা বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো; চরমপন্থী ও জঙ্গি শক্তিসহ সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো; দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো।
এছাড়াও সাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর কথাও বলা হয়েছে। যে প্রতিবেদনে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে জড়িত অপরাধীদের নাম ও অপরাধের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের প্রতিশ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, অর্পিত সম্পত্তি ফেরত আইন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সমতল ভূমির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পৃথক ভূমি কমিশন এবং বৈষম্যবিরোধী আইন বাস্তবায়নে সরকারকে আহ্বান জানানো।
পৃথক সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহ্বান জানানোর সুপারিশও করেছে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগীয় প্রশাসনের কথিত নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার জন্য ভুক্তভোগীদের কারাগারে পাঠানো বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারে প্রতি আহ্বান জানানোর কথাও বলা হয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে উল্লেখ করে সভায় যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশনের কমিশনার স্টিফেন স্নেক বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংখ্যালঘুদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার উন্নয়নের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গভীর আগ্রহ রয়েছে।
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক প্রমুখ।