এইচএসসি ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ : ক্ষোভের সৃষ্টি

Anweshan Desk

Anweshan Desk

০৭ নভেম্বর ২০২২, ১৮:১৮ পিএম


এইচএসসি ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ : ক্ষোভের সৃষ্টি

চলতি বছরের এইচএসসি  ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নেপত্রে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এ পত্রের একটি প্রশ্ন হলো-‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’

শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও প্রশ্নপত্রে ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের বাস্তবিক চিত্রও এমন নয়। ধর্মীয় নানা উৎসবে দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সবাই অংশগ্রহণ করে। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন কাঠামো কেমন হবে-এ ধরনের লিখিত নির্দেশনা এবং প্রশ্ন প্রণেতা ও প্রশ্ন সেটারদের ওরিয়েন্টশন করানো হয়। এর পরেও অমূলক প্রসঙ্গ টেনে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে। এতে করে সমাজে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়তে পারে।

ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র সৃজনশীল ১১ নম্বর প্রশ্নে নাটক সিরাজউদ্দৌলা অংশে অনুচ্ছেদে ধর্মকে সামনাসামনি করে উদ্দীপকে এ কথা বলা হয়। এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে-“(ক) মিরজাফর কোন দেশ হতে ভারত আসেন। (খ) ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব।-ব্যাখ্যা কর। (গ) উদ্দীপকের ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের ‘মিরজাফর’ চরিত্রের তুলনা কর। (ঘ) ‘খাল কেটে কুমির আনা’-প্রবাদটি উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।-উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর।” সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তরের জন্য উদ্দীপকে অনেক প্রাসঙ্গিক উদাহরণ টানা যেত। কিন্তু এখানে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ এবং  সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একাত্তরকে বলেন, এর মাধ্যমে খুবই দুঃখজনক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। প্রশ্ন পত্র প্রণীত, সমীক্ষণ, বিলি করার সময়ও বিষয়টি নজরে আসেনি; বিষয়টি দুঃখজনক। এটি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি অপচেষ্টা বলেই মনে হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের একটি বড়ো উপাদান। কিন্তু প্রশ্নকারী শিক্ষকদের মধ্যে সংবিধানের ন্যূনতম কোনো প্রভাব নেই। কোনো শিক্ষকের মধ্যে যদি সংবিধানের ন্যূনতম স্বাক্ষরতা থাকে তবে তিনি এমন প্রশ্ন তৈরির করতে পারেন না। এখানে সরাসরি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেকটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধ লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

ঢাবির সাবেক এই উপাচার্য বলেন, এখানে শুধু নামগুলো মধ্যেই যে ধর্মীয় বিষয়গুলো টেনে আনা হয়েছে তা নয়, সেখানে মুসলমান শব্দ ব্যবহার, গরু কোরবানি দেওয়ার বিষয়গুলো অতিরঞ্জিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে বলে মনে হয়। এই প্রশ্নপত্র যারা প্রণয়ন এবং মডারেট করেছেন তাদের সবারই এখানে দায় আছে। তাদের এই দায় নিতে হবে। এটা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি একটি কাজ হয়েছে। বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টিতে আসা উচিত। সেই সঙ্গে দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। 

প্রফেসর সিদ্দিক বলেন, যেখানে আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষ মন মানসিকতা তৈরির চেষ্টা করবো, সেখানে এমন প্রশ্নে ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টির পায়তারা করা হয়েছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন লেখক বলেন, শিক্ষক যখন জড় চিন্তার হয়, তখন তো সৃজনশীল প্রশ্নের ধরন সাম্প্রদায়িকই হবে।এই প্রশ্নপত্রটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি  সুকৌশলে সূক্ষ্ম ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে হিন্দুরা ইচ্ছেকৃত দেশত্যাগ করে, তাদেরকে কেউ নির্যাতন করে না, তারা দেশত্যাগ করে মুসলমানদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়, হিন্দুদের চারিত্র মীর জাফরের মতো!

যেখানে এদেশের হিন্দুরা এমনিতেই ঘৃণা, নির্যাতন, হামলা এবং বিতাড়নের শিকার, সেখানে এধরণের প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সেসবকে উস্কে দেয়া এবং জাস্টিফাই করার অপচেষ্টা খুবই  দুঃখজনক। 

এদিকে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন না থাকে সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ওরিয়েন্টশন করানো হয়। প্রশ্নপত্র দেখার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নে বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক উদ্দীপক ছিলো।ট্রেজারি থেকে পান্ডুলিপি এনে দেখে প্রশ্ন প্রনয়নকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই প্রশ্ন নিয়ে সমালোচনার মধ্যে আজ রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সাংবাদিকদের  বলেন, ‘‘খুবই দুঃখজনক যে কোনো একজন প্রশ্নকর্তা হয়ত এই প্রশ্নটি করেছেন এবং যিনি মডারেট করেছেন, সেটি তারও দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে কোনোভাবে৷ আমরা চিহ্নিত করছি, এই প্রশ্ন সেট এবং মডারেট করেছেন কে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব৷’’

তিনি আরও বলেন, কী কী বিষয় মাথায় রেখে প্রশ্ন করতে হবে, তার স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া থাকে শিক্ষকদের৷ সাম্প্রদায়িকতার কিছু যেন না থাকে, সেটাও সেই নির্দেশিকায় আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ৷ এই বাংলাদেশে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানির কোনো কিছু থাকলে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক৷ এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়৷’’

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘যারা চিহ্নিত হবেন, এবং যারা আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে এই ধরনের বীজ বপন করবেন, তাদের এই ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত রাখার প্রশ্ন আসবে না৷’’

উল্লেখ্য, এর পূর্বেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও এমন ধর্মীয়  বৈষম্যমূলক প্রশ্ন করার ঘটনা ঘটনা ঘটেছিলো, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।


Link copied