বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য : মামুনুলদের পক্ষে পিবিআইয়ের বিতর্কিত প্রতিবেদন
১৩ অক্টোবর ২০২২, ২৩:৫২ পিএম

রাজধানীর ধোলাইখালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করাকে কেন্দ্র করে খেলাফত মজলিসের নেতা মামুনুল হকসহ অন্য অভিযুক্তদের দেয়া বক্তব্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ না পাওয়ার দাবি করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এই প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে আসামিদের অবস্থান অপরাধমূলক নয়। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেনি।
এ ধরনের প্রতিবেদনে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে আদালতে আপত্তি দিয়েছে বাদীপক্ষ। পরে আদালত মামলা পুনঃতদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দিয়েছে।
খেলাফত মজলিসের নেতা মামুনুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৩ ও ২৭ নভেম্বর তিনটি সমাবেশে ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করেন। ভাস্কর্য স্থাপন করলে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য ও হুমকি দেয়ার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এবং বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন নামের দু'টি সংগঠন।
এরপর আদালত তদন্তের দায়িত্ব দেয় পিবিআইকে।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে জমা দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, বিবাদি মাওলানা মো. মামুনুল হক, সৈয়দ ফয়জুল করিম এবং জুনাইদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ প্রমাণে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।
এর মধ্যে মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী গত বছরের আগস্টে মারা যান।
পিবিআইয়ের দেয়া এই প্রতিবেদন আপত্তি জানিয়েছে বাদীপক্ষ। মামলাটি এখন তদন্ত করছে সিআইডির ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) বিভাগ।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. আনিস-উজ-জামান প্রিন্সের অভিযোগ, পিবিআই কর্মকর্তা আসামিদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের ভাষা নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন তিনি।
আনিস-উজ-জামান প্রিন্স নিউজ বাংলার বরাতে বলেন, ‘পিবিআইয়ের প্রতিবেদন দেখে মনে হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলই পরিদর্শন করেননি। ঘটনাস্থলের কারও বক্তব্য গ্রহণ করেননি। তিনি আসামিপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে কোর্টে এই রিপোর্ট দিয়েছেন।
‘আমরা আদালতে পিটিশন আকারে যেসব লিংক ও তথ্য দিয়েছিলাম, সেগুলো নিয়েও যথাযথ তদন্ত করা হয়নি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তদন্ত করলে সেগুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করার কথা, কিন্তু পিবিআই তা করেনি। এমনকি প্রতিবেদনের এ সংক্রান্ত কোনো বক্তব্যও নেই। আমরা যে রেফারেন্সগুলো দিয়েছি সেগুলোর ব্যাখ্যা প্রতিবেদনে নেই।’
আনিস-উজ-জামান বলেন, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেছেন, যাত্রাবাড়ীতে উনি শুধু একদিন গিয়েছেন। অথচ আমাদের আবেদনে যাত্রাবাড়ী, বিএমএ মিলনায়তন ও চট্টগ্রামের হাটহাজারির কথা উল্লেখ করেছি। চট্টগ্রাম ও বিএমএ মিলনায়তনে পিবিআই কর্মকর্তার কোনো ভিজিট নেই। চট্টগ্রামের বিষয়ে কোনো মতামতও দেননি।
‘তিনজন আসামির তিনটা ঘটনাস্থল, কিন্তু উনি প্রতিবেদনে কেবল যাত্রাবাড়ী যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।’
তবে বাদীপক্ষের অভিযোগ মানতে রাজি নন পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. তৈয়বুর রহমান। তিনি নিউজবাংলার বরাতে বলেন, ‘আমরা যথাযথভাবেই তদন্ত করেছি। বাদিপক্ষের এই অভিযোগটি সত্য নয়। তদন্তকালে আমাদের সিনিয়র অফিসার তদারকি করেছেন। মামলার অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।‘’
যে কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা
মামুনুল হক, মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলাটি করেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
মামলার আবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর তোপখানা রোডে বিএমএ মিলনায়তনে মামুনুল হক বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। এ মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্ত্বর কায়েম হবে।’
একইদিন গেন্ডারিয়ায় ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে একটি সমাবেশ হয়। সেখানে মামলার ২ নম্বর আসামি সৈয়দ ফয়জুল করিম বলেন, ‘আন্দোলন করব, সংগ্রাম করব, জেহাদ করব। রক্ত দিতে চাই না, দেয়া শুরু করলে বন্ধ করব না। রাশিয়ার লেনিনের ৭২ ফুট মুর্তি যদি ক্রেন দিয়ে তুলে সাগরে নিক্ষেপ করতে পারে তাহলে আমি মনে করি শেখ সাহেবের মূর্তি আজকে হোক কালকে হোক তুলে বুড়িগঙ্গা নিক্ষেপ করা হবে।’
অন্যদিকে ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রারে হাটহাজারীতে এক মাহফিলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের তখনকার আমির জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নাম নেব না। যারা ভাস্কর্য তৈরি করবে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়া হবে। আমার বাবার নামেও যদি কেউ ভাস্কর্য তৈরি করে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেব।’
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
মামলাটি তদন্ত করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) পরিদর্শক মো. তৈয়বুর রহমান। তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন, ভাস্কর্য স্থাপন প্রসঙ্গে বিবাদীদের দেয়া বক্তব্য বিবৃতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা প্রত্যেকেই কোনো একটা ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ধর্মপ্রাণ এই মুসলিমপ্রধান দেশে তাদের রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষী ভাব প্রকাশ ঘটেনি। তাদের বক্তব্যে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসমর্থনমূলক অভিমত প্রকাশ পেয়েছে।
‘আর এই অভিমতের বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রধান দেশের জনগণের সামনে কোরআন হাদিসের আলোকে বিবাদীরা উপস্থাপন করেছে। একটি স্বাধীন দেশে সরকারি কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন: তা যদি হয় জনবিরোধী ও ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক, জাতি ধর্মবিরোধী তবে সেসব কাজের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের জন্য প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে সাংবিধানিক অধিকার।
‘কাজেই ৯০% মুসলমানের এই দেশে ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়ে বিবাদীদের এহেন কাজ রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের আওতাধীন নয়।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সারা মুসলিম বিশ্বে মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত, মুসলমানদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য বিবাদীরাসহ দেশের বিশিষ্ট আলেম দেশের বিশিষ্ট ইসলামিক জ্ঞান সম্পন্ন আলেমগণ ধর্মের প্রশ্নে বজ্র কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাজেই তাদের এই কাজ রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে বিবেচ্য নয়।’
মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব পেয়ে স্বাক্ষীদের বক্তব্য নিতে শুরু করেছে সিআইডির ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) বিভাগ। তদন্তের সবশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে বিশেষ পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান নিউজবাংলার বরাতে বলেন, ‘তদন্ত চলমান আছে। এটি শেষ হলে বিস্তারিত বলা যাবে।’