কটূক্তির অভিযোগে হিন্দু শিক্ষকের ৮ বছরের কারাদণ্ড, আতঙ্কে স্ত্রী-সন্তান ঘরছাড়া
০৭ জুলাই ২০২২, ১৪:৪০ পিএম

ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কথিত কটূক্তির হুজুগে ৮ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দেবব্রত দাশ দেবুর পরিবার এখনো এলাকায় ফেরেনি। ছোট্ট দু’টি সন্তানকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী আঁখি রানী দাশ আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন। খবর ডিডব্লিউ বাংলার। ভয়-আতঙ্কে ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না। স্বামীর এমন সাজায় বিস্মিত-হতবাক এই নারী। স্বামী কারাগারে এখন কী করবেন ভাবতেও পারছেন না।
ভিক্টিম শিক্ষকের স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম ডিডব্লিউ বাংলা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “স্বামীর সাজা হওয়ার পর এখন খুবই মানসিক বিপর্যয়ে আছি। মামলা হওয়ার পর দেবব্রতকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে তখন আমাদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। অনেক কিছু ভাঙচুর করেছিল, নিয়েও গিয়েছিল। রায়ের আগের দিন আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর দেবব্রত আমাকে বলেছিল, এই পোস্ট তিনি দেননি। পুলিশের মারধরের ভয়ে তিনি এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।”
হিন্দু বৌদ্ধ খিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এখন যে পরিস্থিতি তাতে আঁখি বাড়ি ফিরতে ভয় পাবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে তাকে বাড়িতে ফিরতে হবে। প্রয়োজনে আমরা প্রশাসনকে বলে দেবো। সারাদেশেই এখন সংখ্যালঘুরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। নানা অজুহাতে তাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা বারবার বলে আসছি, কিন্তু সরকার আমাদের কথা শুনছে না।”
গত ৪ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইবুনালের বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল কবিরের আদালত স্কুল শিক্ষক দেবব্রত দাসকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে 'অবমাননাকর বক্তব্য' দেয়ার অভিযোগে আট বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড শাস্তির রায় দিয়েছেন।
মামলার নথি এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের ১৫ ও ২৮ তারিখে নোয়াখালীর হাতিয়ায় ইসলাম ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন শিক্ষক দেবব্রত দাস বলে অভিযোগ তোলে স্থানীয় উগ্রপন্থী মুসলমানদের একটি চক্র। এছাড়া তাঁর গ্রেফতার ও ফাঁসীর দাবিতে তৌহিদী জনতার ব্যানারে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি করে ধর্মান্ধ ও উগ্রপন্থীদের চক্রটি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হাতিয়া থানার পুলিশ সদস্য হুমায়ূন কবীর বাদী হয়ে, তাকে অভিযুক্ত করে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করে।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, শিক্ষক দেবব্রত ১৫ অক্টোবর রাত ৯টা ১২ মিনিটে ও ২৮ অক্টোবর রাত ৮টা ৫৯ মিনিটে তার ফেসবুক আইডি থেকে দেয়া পৃথক দুটি পোস্টে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করে নানা বক্তব্য লিখেন। এতে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টি হয়েছে। মামলার পর, ঐ দিনই পুলিশ দেবব্রত দাসকে হয়রানীমূলক গ্রেপ্তার করে।
এরপর, ২০১৮ সালের ১০ জুন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলার চার্জ গঠন করেন। পরে মামলাটি বিচারের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ৪ জুলাই সোমবার চট্টগ্রামের বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল কবীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দেবব্রত দাসকে আট বছরের কারাদণ্ডের সাজা শোনান। সাজা ঘোষণার পরেই দণ্ডপ্রাপ্ত শিক্ষককে কারাগারে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য, বিলুপ্ত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (২০১৮) বেশকিছু ধারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। বিগত বছরগুলোতে এই আইনের অপব্যবহারের কারণে অসংখ্য মানুষ হয়রানির শিকার আসছেন। বিশেষ করে অনলাইন এক্টিভিস্ট, ব্লগার, গণমাধ্যম কর্মী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হয়রানি করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই কালো আইন।
এই আইনের মাধ্যমে কাউকে শাস্তি দেয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার বড় অন্তরায় ও সার্বজনীন মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো।