২০১৮ সালে নারীদের ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধে ইসলামি আন্দোলনের বিক্ষোভ, ২০২২ সালে বাংলাদেশের নারীদের সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ জয়

Anweshan Desk

অন্বেষণ ডেস্ক

২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:৪৬ এএম


২০১৮ সালে নারীদের ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধে ইসলামি আন্দোলনের  বিক্ষোভ, ২০২২ সালে বাংলাদেশের নারীদের সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ জয়

২০১৮ সালে নারীদের ফুটবল খেলায় বিরোধিতা, ২০২২ সালে ফুটবলে নারীদের শিরোপা জয়

গত ২০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সাত জাতি ষষ্ঠ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নারী সাফে বাংলাদেশ প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কৃষ্ণা সরকারের দুটি আর শামসুন্নাহারের গোলে শিরোপা জয় করে টাইগার টিম।

কিন্তু এই শিরপা জয় নিয়ে এবার বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল পড়ে গেছে। উঠেছে নানান তর্ক বিতর্ক। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের শিরপা জয়কে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ নারীদের ফুটবল খেলা হারাম এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরই মধ্যে চার বছর আগের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নারী ফুটবল বন্ধের দাবীতে ব্যানার নিয়ে করা মিছিলের একটা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় মেয়েদের ফুটবল বন্ধের দাবিতে ২০১৮ সালে একটি বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন স্থানীয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংগঠনের নেতারা।

এবার সেই ছবি দিয়েই ফুটবল নেটিজেনদের একাংশ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিনা বিচারে কারাগারে বন্দী থাকা কার্টুনিস্ট কিশোরের আঁকা একটি ছবিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে তেঁতুল হুজুর নামক খ্যাত হেফাজতের সাবেক আমির মরহুম শফি হুজুরের মুখাবয়বের ন্যায় একজন ব্যক্তি তার পিছনে একজন নারী ফুটবল কিক দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ছবি দিয়েও অনেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আবার এদেশের ইসলাম ধর্মভীরুদের একাংশ বাংলাদেশ নারী ফুটবল টিমের বিদেশের মাটিতে বসে ফাইনালে শিরপা জয়ের পরেও নারী ফুটবলের বিরোধিতা করে ফেসবুকে পোস্ট করে যাচ্ছেন।

গত চার বছর আগে কি ঘটেছিলো কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে সেটা নিচে আলোচনা করা হলো।

২০১৮ সালের ৮ মার্চ কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে রোমানা স্পোর্টিং ক্লাবের আয়োজনে একটি মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। আর সেই টুর্নামেন্টকে ঘিরেই নারী ফুটবলের বিরোধিতায় নামে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ নামের একটি ধর্মীয় সংগঠন। তারা সেই মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট  বন্ধের প্রতিবাদে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছিলো। তারা তাদের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে অভিযোগ করে যে ছোট পোশাক পরে মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলা শরিয়ত বিরোধী তাই তারা সেটার বন্ধের জোর দাবী জানায়।

সেই বছর ইসলামি আন্দোলনের এই বিক্ষোভের স্বপক্ষে সহমত পোষণ করে ফেসবুকে ঝড় তুলেছিলেন বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বিশাল একটি অংশ। তাদের অনেককেই ফেসবুক পোস্ট করতে দেখা যায় এই লিখে যে রাধা আর চুল বাঁধাই হচ্ছে মেয়েদের কাজ, মাঠে কেন ছোট পোশাকে খেলবে মেয়েরা৷ 

সেদিন নাগেশ্বরী বাজার মসজিদ এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে।

সমাবেশ শেষে সংগঠনের নেতারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন টুর্নামেন্ট বন্ধের দাবিতে ইউএনও’কে স্মারকলিপি দেন বিক্ষোভকারীরা।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জিএমএম আনছার আলী রয়েল, উপজেলা সভাপতি মাওলানা আব্দুস শাফী, সেক্রেটারি মাওলানা রফিকুল ইসলাম প্রমূখ।

ইসলামি আন্দোলনের এই বিক্ষোভ সমাবেশের পরপরই টুর্নামেন্ট আয়োজনকারীরা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চান নি, তাই পরবর্তীতে তারা টুর্নামেন্টটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।

আবার ঠিক সেই চার বছর পরে এসে আবার সেই ধর্মীয় ফতোয়া জারি শুরু হয়ে গিয়েছে। এবার বাংলাদেশের শায়খ আহমাদুল্লাহ নামের এক বিশিষ্ট আলেম বাংলাদেশের নারীদের ফুটবল খেলার বিষয় নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। নিচে তার ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা হলো।

মহিলা ফুটবল দলের শিরোপা জেতায় যারা অতি উৎফুল্ল, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় পর্দানশীন মেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করার ঘটনায় তাদের উৎফুল্ল হতে দেখা যায় নি কেন? লক্ষ্য যদি নারীর উন্নতি হয় তাহলে দ্বিতীয় ঘটনায় কেন অভিনন্দন জানানো হয় না?

যারা নারী ফুটবলারদের দিয়ে এদেশে 'ধর্মবিদ্বেষ' কায়েম করতে চাইছেন, তাদের ভাবখানা এমন যেন মহিলা ফুটবল দল নেপালের বিরুদ্ধে খেলতে নামে নি, বরং ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল! এ ইস্যুতে গতকাল থেকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অবমাননা করে যেসব জঘন্য কার্টুন ছড়ানো হচ্ছে তা সমাজকে বিশৃঙ্খল করার অপপ্রয়াস।

বাস্তবতা হলো, এদেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ। খেলোয়াড়রাও এর বাহিরে নন। আপনারা যাদের ‘ইউজ’ করে ইসলামবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তাদের একজন আল্লাহর উপর ভরসার কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। আরেকজন মাকে নামাজ-রোজা করতে বলেছেন। কখনো আবার পুরো দল সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। এ থেকে পরিষ্কার যে, তারা মুসলমানের সন্তান। তারা আমাদেরই বোন। হয়তো ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা তাদের নাই। যারা পাহাড়ী আছেন, তারাও আমাদের অংশ।

তাছাড়া এসব মেয়েরা নিতান্ত গরীব ঘরের সন্তান। যদি তারা একটু সচ্ছল ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতেন তাহলে তাদের কয়জন ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। সুতরাং ‘নারীবাদ’-এর মতো বড়লোকি তত্ত্ব তাদের জীবনে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বহীন।

অতএব, এদের দিয়ে ইসলাম বিদ্বেষ ও আলেমদের প্রতি ঘৃণার চাষাবাদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এই দেশে সফল হবে না। বরং তাদের মধ্যে সামান্য দা’ওয়াতী কাজ করা গেলে এরা একেকজন হাজারো মানুষের হেদায়েতের কারণ হতে পারেন ইন শা আল্লাহ।

তবে এটা সত্য যে, যেটাকে খেলা বলা হচ্ছে সেটা মূলত: একটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সেই আগ্রাসনে যাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক সময় তারা নিজেরাও জানেন না যে, কিছু পয়সার বিনিময়ে তাদের কোন্ কাজে ইউজ করা হচ্ছে। মহান আল্লাহ তাদের ও ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ লালনকারীদের হেদায়েত দান করুন।

এত সব সাম্প্রদায়িক বাঁধা থাকা স্বত্তেও বাংলাদেশের নারী ফুটবল টিম বিজয় ছিনিয়ে শিরোপা উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশকে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে আরও


Link copied