ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ চায় জাতিসংঘ
২১ অগাস্ট ২০২২, ২১:০৭ পিএম

ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ চায় জাতিসংঘ
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ এবং ২৮) বাতিলের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা এ দুটি ধারায় করা মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো অপ্রীতিকর অশালীন মিথ্যা তথ্য প্রচার করে কিংবা প্রপাগাণ্ডা চালায় তাহলে ১৪ বছরের জেল বা ১ কোটি টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হবেন।
২৮ নং ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি জ্ঞাতসারে ডিজিটাল ডিভাইস কিংবা মাধ্যম দিয়ে কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে থাকেন তাহলে ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হবেন।
এ দুটি ধারা বাতিলের দাবিসহ একই অভিযোগে করা মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া সংশোধনের দাবি জানিয়েছে আইনের ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা। ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব দাবি জানান ঢাকায় সফর করা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ও চিলির সাবেক রাষ্ট্রপতি মিশেল ব্যাচলেট।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দি অবস্থায় মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। মুশতাক সম্পর্কে যখন উনি প্রশ্ন করেছেন, আমি পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা তাঁকে পড়ে শুনিয়েছি। তারপর তিনি আর প্রশ্ন করেননি। ’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার উদ্বেগ জানিয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো উদ্বেগ ছিল না, এটা আলোচনার মধ্যে এসেছে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, পদ্মার বৈঠকে আইনের দুটি ধারা বাতিলসহ আরও ছয়টি ধারা সংশোধনের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন। এ ছাড়া মুক্তমনা লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যু, ১০ মাস কারাবন্দি থাকার পর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জামিন দেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি লেখা শেয়ার দেওয়ার কারণে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের দীর্ঘদিন নিখোঁজ ও কারাগারে থাকা নিয়েও আলোচনা হয়।
এসব ব্যক্তি ছাড়াও যাঁরা এ আইনের অধীনে মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়। আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই ২১ ও ২৮ ধারা সরাসরি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন। এমনকি এ দুটি ধারায় দেশে অতীতে যত মামলা হয়েছে এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হচ্ছে।
আইনের ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা সংশোধনেরও দাবি তাদের। এর মধ্যে ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়ে পেনাল কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্য এবং ৩২ ধারার অফিশিয়াল সিক্রেসি-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ২৭ ধারাটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা ও ৪৩ ধারার ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতারের বিষয়টি দ্রুত সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিল তারা।
২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। আইনটির গেজেট প্রকাশ করা হয় একই বছরের ৯ এপ্রিল। আইনের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে এবং জনগণের মাঝে ভয়ভীতি সঞ্চারের জন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে বৈধ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা করায়, তাহলে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড। জরিমানা ১ কোটি টাকা। অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ভঙ্গ করে কোনো অপরাধ করেন তাহলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করবেন। জরিমানা ৫ লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয়ে ৩১ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, এজন্য অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমনা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ প্রসঙ্গে ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি-গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন তাহলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা। ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ আইনের ৪৩ ধারা পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফরম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যে-কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।