দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে নির্মিত হচ্ছে মসজিদ

Anweshan Desk

ডেস্ক রিপোর্ট

২৩ মার্চ ২০২৪, ১৭:২১ পিএম


দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে নির্মিত হচ্ছে মসজিদ

মসজিদের একটি ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করছেন সংসদ সদস্য জাকারিয়া জাকা

দিনাজপুরের কাহারোলে ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে মসজিদ নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ আছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এই স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। কান্তনগর গ্রামে রাজ দেবোত্তর এস্টেটের জমিতে মসজিদ নির্মাণের ঘটনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনাজপুর-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাকারিয়া জাকা এ কাজে সহযোগিতা করছেন। গত ১ মার্চ সবকিছু জেনেশুনেও মসজিদ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন তিনি। এমনই তথ্য উঠে এসেছে কালবেলার প্রতিবেদনে।

এ নির্মাণকাজ বন্ধ চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট রণজিৎ কুমার সিংহ। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বলছে, অভিযোগের পর নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। উভয় পক্ষের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে সিদ্ধান্ত হবে। তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, মসজিদের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

এদিকে পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান দিনাজপুরের ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দিরের দেবোত্তর ভূমিতে অবৈধভাবে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। মন্দিরের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পরিষদের নেতারা।

দিনাজপুর জেলা পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ কালবেলাকে বলেন, মন্দিরের পাশে মালিকানায় বিরোধপূর্ণ জমিতে স্থায়ী অবকাঠামো দিয়ে পাকা করে মসজিদ নির্মাণের চেষ্টা হচ্ছিল। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কাগজপত্র যাচাই করে সেটির কাজ স্থগিত রেখেছে।

পুলিশ সুপার বলেন, ওই ঘটনার জেরে কেউ যেন গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সেদিকে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

গতকাল শুক্রবার রণজিৎ কুমার সিংহ কালবেলাকে বলেন, কান্তনগর মৌজায় কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে এ মসজিদটি নির্মাণ হচ্ছে। অথচ জমির কোনো রেকর্ড তাদের নামে নেই। তিনি জানান, খবর নিয়ে দেখেছি, শুক্রবার নির্মাণকাজ হয়নি। তবে রাতের অন্ধকারে কাজ করলে কে ঠেকাবে।

মন্দিরের জমিতে মসজিদ নির্মাণ করায় ক্ষুব্ধ সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, পুরকীর্তি সমৃদ্ধ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান ঐতিহাসিক এই কান্তজিউ মন্দির। মন্দিরের বিশাল জমি দীর্ঘদিন ধরে বেহাত পড়ে আছে। এই সুযোগে একটি চক্র আগে থেকেই টিনের চালা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করে। এখন সেখানে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটি গোষ্ঠী এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ তাদের।

এদিকে স্থানীয় সুমলমানরা বলছেন, মামলা এবং আপস নামামূলে এই জমির মালিক কান্তনগর গ্রাম জামে মসজিদ।

গত ১৩ মার্চ রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট রণজিৎ কুমার সিংহ জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলেছেন, ‘জেলার কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মৌজায় সিএস ২নং খতিয়ানটি শ্রীশ্রী কান্তজিউ বিগ্রহ পক্ষে সেবাইত অনারেবল মহারাজা জগদীশ নাথ রায় নামে প্রচারিত। ওই খতিয়ানে কান্তজিউ বিগ্রহর নামে ৯৪.০৭ একর জমি রয়েছে। এসএ ০৫নং খতিয়ানে দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের পক্ষে জিম্মাদার জেলা প্রশাসক ১৯টি দাগে ৬২.৪৬ একর জমি রয়েছে। বাংলা ১৪৩০ সন পর্যন্ত জমির খাজনা হালনাগাদ রয়েছে। গত ১০ মার্চ জানতে পারেন যে, কান্তনগর মৌজার ১৬নং দাগে রাজ দেবোত্তর এস্টেটের সম্পত্তির ওপর একটি পাকা মসজিদ তৈরি করা হচ্ছে। এটা শুনে গত ১১ মার্চ নির্মাণাধীন মসজিদের জায়গাটি পরিদর্শন করি, দেখি মসজিদটি রাজ দেবোত্তর এস্টেটের কান্তনগর মৌজার এসএ ৫নং খতিয়ানের ১৬নং দাগের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে।’

লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি মোজাম্মেল হকের কাছে কীভাবে রাজ দেবোত্তর এস্টেটের জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করছেন—জানতে চাইলে তিনি জানান, ১৯৭৬ সালে ডিসি দিনাজপুর ওই জমি তাদের দিয়েছেন। তার কাছে দলিল দেখতে চাইলে তিনি একটি হাতে লেখা তিন পৃষ্ঠার আপসনামার ফোটোকপি দেন। কথিত আপসনামাটি যাচাই করে দেখি, উহা কোনো বরাদ্দ নয়। এটি কোনো রেজিস্ট্রিকৃত জমির দলিল নয়। ওই কাগজে মালিকানা হস্তান্তরের কোনো কথা উল্লেখ নেই। আপসনামাটি ভুয়া ও বানোয়াট মনে হয়।

তা ছাড়া ১৯৯৯ সালের ৫১ডিএলআর বলা হয়েছে, দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য নয়, উহা সব সময়ের জন্য দেবোত্তর সম্পত্তি। রাজ দেবোত্তর এস্টেটের সম্পত্তিতে অবৈধভাবে মসজিদ নির্মাণকাজ শুরু করায় এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাই অবিলম্বে কাজ বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি।’

এই আবেদন পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক কাহারোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কাজ বন্ধসহ তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

 

কাহারোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখতে মসজিদ কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছি। এটি দেবোত্তর সম্পত্তি, তদন্ত চলছে। বর্তমানে কাজ বন্ধ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সরেজমিন মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুস সালামের সঙ্গে কথা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এখানে আগে থেকেই কাঁচা মসজিদ ছিল। এখন ২৫ লাখ টাকা চাঁদা তুলে তিনতলার ভিত দিয়ে সমজিদটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর আগে এই জায়গাটি নিয়ে আদালতে মামলা হয়। সে সময় মামলার আদেশে উভয় পক্ষকে আপস করে নেওয়ার জন্য বলা হয়। সেই সূত্রে গত ১৩.০৬.১৯৭৬ ইং তারিখে একটি আপসনামা মূলে ৮ শতাংশ জমির মালিক মসজিদ।’

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, কাজের জন্য সব রকমের নির্মাণ সামগ্রী রাখা আছে। নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। বেশ কয়েকজন শ্রমিককে বালু আনা-নেওয়ার কাজ করতে দেখা গেছে। মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কাজের নামফলক রয়েছে এখানে। শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা রয়েছে, ‘কান্তনগর গ্রাম জামে মসজিদের তৃতীয় তলা ফাউন্ডেশন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মো. জাকারিয়া জাকা, সংসদ সদস্য, দিনাজপুর-৬, দিনাজপুর-১। ১ মার্চ ১০২৪।’ ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানের ছবি নিজের ফেসবুকে আপলোড করেছেন এমপি জাকারিয়া।

এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য মো. জাকারিয়া জাকা কালবেলাকে বলেন, ‘শুনেছি ৭৫ বছর ধরে ওই এলাকায় মসজিদ রয়েছে। নতুন করে সমজিদের ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি দেবোত্তর সম্পত্তি বলে পরে জানতে পেরেছি। এজন্য মসজিদ কমিটির দাবি করা এই সম্পত্তি বৈধ কি না, আমার জানা নেই। তারা দাবি করছে, জেলা প্রশাসন থেকে কাগজপত্র করা হয়েছে। এই কাগজপত্র সঠিক কি না, আমি জানি না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যখন মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি, তখন বিষয়টি জানা ছিল না। পরে উভয় পক্ষ থেকে জমি দাবি করা হয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখভাল করছে। এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে এর সঙ্গে আমি একমত থাকব। যারা জমির বৈধ মালিক তাদের পক্ষে থাকতে আমার কোনো দ্বিমত নেই।’

দিনাজপুর জেলা হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রতন সিং কালবেলাকে বলেন, রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করার পর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা এর সঠিক তদন্ত চাই।

জানতে চাইলে এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল কালবেলাকে বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য গত ১ মার্চ সব জেনে-শুনেই সমজিদের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মূলত তিনিই সমজিদ নির্মাণে সহযোগিতা করছেন। তিনি বলেন, মসজিদের নির্মাণকাজ বন্ধে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি।

তিনি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি সমাধানে বসার কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এদিকে মসজিদ নির্মাণকাজ এগিয়ে যাচ্ছে। নির্মাণ হয়ে গেলে তো স্থাপনা আর ভাঙা যাবে না। তাই যা কিছু করতে হয় আগেই করা উচিত।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে আরও


Link copied